যে বয়সে অন্য শিশুদের সাথে খেলাধুলায় মাতিয়ে থাকার কথা, ঠিক সে বয়সে ঘরের মধ্যে বন্ধী শাহাদাতের জীবন। বয়স মাত্র ১০ বছর হলেও দেখতে তাকে বৃদ্ধের মত দেখায়। তাই অন্য শিশুরা তাঁর সাথে মিশতে চায়না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে একমাত্র ছেলেকে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তাঁর বাবা-মায়ের।
জন্মের ৪ মাস পর থেকে প্রোজিরিয়া নামক রোগে আক্রান্ত হন চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মো. শাহাদাত হোসেন। উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের মাইজগাঁও গ্রামের মো. হানিফ ও নাছিমা আক্তারে ৩ সন্তানের মধ্যে সে সবার ছোট ছেলে। শাহাদাত মির্জাবাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত।
জানা গেছে, মো. শাহাদাতের জন্মের ৪ মাস পর থেকে হঠাৎ করে শরীরে বিরল রোগে আক্রান্ত হয়। তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ১ মাস ১৪ দিন চিকিৎসা নিয়েছেন। চিকিৎসা নিলে কোন উন্নতি হয়নি। চিকিৎসক বলেছেন এ রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই। ১ মাস ১৪ দিন থাকার পর তারা গ্রামে চলে আসেন। দু’বছর পর তার শরীরে দেখা দেয় হার্নিয়া রোগ। এরপর অপারেশন করা হয়। তবে এখনো মাঝে মাঝে ব্যাথা করে।
শাহাদাতের বাবা মো. হানিফ বলেন, দুটি মেয়ের পর আমার একটি ছেলে সন্তান হয়। অনেক খুশী হয়েছি। কিন্তু কিছুদিন পর আমার একমাত্র ছেলের শরীরের রোগ দেখা দেয়।
যখন তার এই রোগ দেখা দিয়েছে, তখন তাকে নিয়ে চমেক হাসপতালে ১ মাস ১৩ দিন ছিলাম। ডাক্তারের চিকিৎসা ফ্রি পেয়েছি, কিন্তু ঔষধ তো আর ফিরে পাইনি। জায়গা সম্পত্তি কোন কিছু নাই যে, বিক্রি করে ছেলের চিকিৎসা করাবো। একবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য এসে ছবি তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু আর কোন যোগাযোগ করে নাই তারা। আমার ছেলেটা যদি একটু পরিবর্তন হয় তাহলে অন্যান্য মানুষের সাথে চলাফেরা করতে পারতো। তখন আমি মরে গেলেও শান্তি পেতাম। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মিরসরাইয়ের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের কাছে আকুল আবেদন করবো যেন, আমার ছেলেটার সুস্থতার জন্য যেন একটু সহযোগিতা করে।
মো. হানিফ আরো বলেন, সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি আমি। রিক্সা চালিয়ে সংসার এবং ছেলের চিকিৎসা খরচ চলছে। দৈনিক ৫০০/ থেকে ৬০০ টাকা ইনকাম হয়। তার মধ্যে ২৫০ টাকা মালিককে দিয়ে দিতে হয়। নিজের কোন জায়গা সম্পত্তি নেই। স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে নিয়ে সওজের জায়গার উপর কোন রকম করে দিন কাটছে। জানিনা কতদিন থাকতে পারবো এই জায়গার উপর। শুনতেছি রাস্তা নাকি আরও বড় হবে, রাস্তা বড় হলে তো আমাদের এখানে থাকা সম্ভব না।
তিনি আরও বলেন, শাহাদাতের কোন খেলনা ভালো লাগে তা কিনে দিতে পারি না, তখন নিজের কাছে অনেক কষ্ট লাগে, সেই জন্য তাকে বাজারে অথবা দোকানে কোথাও নিয়ে যেতে পারি না। রিক্সাও বেশিক্ষন চালাতে পারি না, তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আসি, ভয়ে থাকি সবসময় যদি রাস্তায় চলে যাই। কোনকিছু হয়ে গেলে তাহলে তো আমি আর বাঁচতে পারবো না। আমার সবকিছু তাকে নিয়ে। তার এই সমস্যার কারণে অনেকে গালমন্ধ করে, তবুও কিছু বলতে পারি না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ ঘেঁসে ছোট্ট একটি ঘরে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে থাকেন হানিফ। ঘরের সামনে দূরন্তপনায় মেতেছে শাহাদাত। সাইকেল চালাচ্ছেন, বিভিন্ন কথা বলছেন। সব আচরণ শিশুসুলভ হলেও শরীর দেখে মনে হচ্ছে তাঁর বয়স ৬০। বাবার চেয়ে ছেলের বয়স বেশি বোঝা যাচ্ছে।
অসুস্থ মো. শাহাদাত বলেন, আমার স্কুলের স্যারেরা আমাকে অনেক আদর করে। কিন্তু আমার বন্ধুরা আমার সাথে খারাপ কথা বলে। আমার সাথে খেলতে চাই না। আমি খেলতে গেলে তারা আমাকে দলে নেয়না। আমি সুস্থ হয়ে আমার বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করতে চাই এবং পড়ালেখা করতে চাই। পড়ালেখা করে আমি বড় হয়ে এসি বাস চালাবো।
শাহাদাতের মা নাছিমা আক্তার বলেন, আমার ২ মেয়ে ১ ছেলে। ছেলেটা জন্মের কিছুদিন পর তার শরীরে বিরল রোগ দেখা যায়। এলাকার মানুষজন থেকে টাকা-পয়সা তুলে চিকিৎসা করেছিলাম, কিন্তু কোন উন্নতি হয়নি। চিকিৎসক বলেছে এ রোগের চিকিৎসা বাংলাদেশে নাই, তাকে সুস্থ করে তুলতে হলে বিদেশ নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। ছেলেকে বিদেশ নিয়ে চিকিৎসা করাবো। আমাদের জায়গা সম্পত্তি বলতে কিছু নেই, সড়কের জায়গার উপর ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সেখানে ঘর বেঁধে রয়েছে। শুনতেছি রাস্তা আরও বড় হবে, তখন তো আমাদেরকে এ জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। তখন আমার অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে কোথায় থাকবো এই বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে শাহাদাতকে দেখলে অন্যান্য ছেলেরা ভয় পাই তখন আমার ছেলে আমাকে বলে, আম্মু আমাকে দেখে সবাই ভয় পাই কেন? তখন আমি বলি বাবারে আল্লাহ তোমাকে বানাইছে সে আল্লাহর কাছে তোমাকে সুন্দর লাগতেছে, আমার কাছেও তোমাকে সুন্দর লাগতেছে। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুল আবেদন করবো যেন, আমার ছেলেটাকে সুস্থ করার জন্য সহযোগিতা করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জানা গেছে, অকাল জরার ইংরেজি পরিভাষা প্রোজিরিয়া। যার অর্থ পূর্বে বা অপরিপক্ব বয়সে বৃদ্ধ। অকাল জরাগ্রস্ত রোগী সাধারণত ১৩-১৪ থেকে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মিনহাজ উদ্দিন বলেন, শিশুটির ছবি দেখে মনে হচ্ছে সে প্রোজিরিয়া রোগে আক্রান্ত। এটা জেনেটিক কারণে হয় এবং এ রোগে অঅক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিরল। শিশু বয়সে গায়ের চামড়া কুচকে যাওয়া, বৃদ্ধের মত দেখতে এসব এ রোগের লক্ষণ। একে দ্রুত ঢাকা পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।
ওয়াহেদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল কবির ফিরোজ বলেন, হানিফের জায়গা সম্পত্তি বলতে কিছু নেই, তারা খুবই গরিব। তার ছেলে শাহাদাতকে পরিষদ থেকে একটি প্রতিবন্ধি কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবেও তাকে সহযোগিতা করেছি। ইউএনওর সাথে যোগাযোগ করে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিবো বলেও জানান তিনি। সাহায্য পাঠাতে চাইলে বিকাশ ও নগদ নম্বর ০১৮৭৮৪৯০৪০৯ (হানিফ বাবা)। ব্যাংক হিসাব ০২৬৩১২২০০০০৩২১৮ (নাছিমা বেগম মা), ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, বড়তাকিয়া শাখা, মিরসরাই, চট্টগ্রাম।