প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানার দৈর্ঘ্য চার হাজার ৯৬ কিলোমিটার। দুই দেশের এই সীমান্তে নানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে গত অর্ধশতক ধরেই। এসব হত্যাকাণ্ডে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন সময় টানাপড়েন দেখা গেছে।
বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষী মনোভাবের অন্যতম কারণ সীমান্তের হত্যাকাণ্ড। জাতীয় নির্বাচনের দুই সপ্তাহ পর গত ২২ জানুয়ারি যশোরের বেনাপোল সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এর গুলিতে মারা যান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একজন সদস্য। হত্যাকাণ্ডের তিনদিন পর তার লাশ ফেরত পায় বাংলাদেশ। ঐ ঘটনার পর হঠাৎই ভারত বিরোধিতার বিষয়টি বেশি লক্ষ্য করা যায়।
গত কয়েক সপ্তাহ হলো বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, এক্স ও ইউটিউবের মাধ্যমে সাম্প্রতিক ‘ইন্ডিয়া আউট’ নামে ভারত বিরোধী এক ধরনের প্রচারণা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পণ্যসহ দেশটিকে 'বয়কট' নিয়ে করা বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন চলছে। যারা এসব প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ কিংবা সরকার-বিরোধী হিসেবে পরিচিত। এর সঙ্গে ছোটখাটো কয়েকটি রাজনৈতিক দলও রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব প্রচারণা ভারতেও অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশের এসব প্রচারণার বিরুদ্ধে ভারতের অনেকে ইউটিউবে পাল্টা জবাব দিচ্ছেন।
সম্প্রতি ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ঢাকার অলিগলিতে এক তরুণ হ্যান্ডমাইক হাতে ভারতের পণ্য বর্জনের প্রচারণা চালাচ্ছেন। সে গণঅধিকার পরিষদের একজন নেতা। সেই সঙ্গে এবি পার্টির মতো কয়েকটি ক্ষুদ্র দলের নেতা-কর্মীরা সম্পৃক্ত হয়েছেন। এসব দল গত ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর থেকে নানাভাবে ভারত-বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে।
এদিকে নির্বাচন বয়কটের ডাক দেয় বিরোধী রাজনৈতিক জোট বিএনপি। ফলে অনেকটা একতরফা নির্বাচনে জয় নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিয়েও ছিল নানা প্রশ্ন।
বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের একটা অংশ মনে করছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর নয়াদিল্লীর কুটনৈতিক সমর্থনের কারণেই বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। যে কারণে এবার নির্বাচন বয়কট করে এই সামাজিক আন্দোলনে তরুণদের একটা অংশ।
এই নির্বাচনের পরপর দেশ ও দেশের বাইরে থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ধরনের প্রচারণা শুরু হয়। হ্যাশট্যাগ ‘ইন্ডিয়াআউট’ এই প্রচারণায় তখন সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই যোগ দেন। হ্যাশট্যাগের এই প্রচারণাটি ফেসবুক, এক্স(টুইটার), ইন্সটাগ্রামেও এখন শীর্ষে দেখা যাচ্ছে। যেখানে বেশিরভাগ পোস্টদাতাই বলছেন, বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। যে কারণে এই ধরনের প্রচারাভিযানের মাধ্যমে তারা ভারতীয় পণ্য বয়কটেরও ডাক দিচ্ছেন।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারতের রাজনীতি ও কুটনৈতিক অঙ্গনে। দুটি দেশের দায়িত্বশীল সূত্রই এই ‘ইন্ডিয়াআউট’ নিয়ে কথা বলছেন। এতে বাংলাদেশে এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের অনেককেই এই ধরনের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। এমন অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত বিদ্বেষী মনোভাবের কারণে দুই দেশের সম্পর্কে কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। এ নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রী কথাও বলেছেন সাম্প্রতিক।
শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের জনগণ 'ভারত বিদ্বেষী' হয়ে উঠছে, সেক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়বে কী-না? জবাবে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের কোন টানাপড়েন নেই’।
অপরদিকে গত মঙ্গলবার ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট আয়োজিত এক প্রশ্নোত্তর যোগ দিয়েছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। সেখানে নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, মালদ্বীপের পর ভারতেও এক ধরনের ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন চলছে। এর প্রভাব কী হতে পারে? তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে যা দেখবেন তার সবটুকু বিশ্বাস করবেন না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভারতীয়দের বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যেতে এবং বাংলাদেশি বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। যা ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে’। আগে উত্তর-পূর্বের মানুষদের শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে নেমে পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে যেতে হতো। এখন তারা চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারে। এটি সমগ্র পূর্ব ভারতীয় অর্থনীতি বদলে দিবে।
ভারতীয় গণমাধ্যম ফার্স্টপোস্টের একটি ইউটিউব পেইজে সাংবাদিক পালকি শর্মাকে বাংলাদেশের এই ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন নিয়ে একটি বিশ্লেষণ করতে দেখা গেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানই এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পেছন থেকে। যদিও 'ভারতীয় পণ্য বয়কট' কিংবা 'ইন্ডিয়া আউট' প্রচারণা নিয়ে বিএনপি দল হিসেবে কিছু বলেনি বা প্রচারণায়ও অংশ নেয়নি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা রাজনৈতিকভাবে এমন কোন সিদ্ধান্ত এখনো নেই নাই। যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন আন্দোলনের ডাক দিয়েছে সেটা তাদের অধিকার। দলের পক্ষ থেকে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তবে কিছুদিন আগে তিনি গণমাধ্যমে বলেছিলেন, এই সরকার ভারত, রাশিয়া ও চীনের সরকার।