ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর থেকেই অস্থিরতা চলছে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের বাজারে। বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাতও অব্যাহত রয়েছে। ফলে ক্রমবর্ধমান রয়েছে ইউরো অঞ্চলের মূল্যস্ফীতি। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পণ্য ও সেবার দাম। আবার রাশিয়া ধীরে ধীরে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় অঞ্চলটিতে জেঁকে বসছে মন্দার ঝুঁকিও। এ অবস্থায় গত মাসে অঞ্চলটির শিল্পোৎপাদন কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছে। দুর্বল চাহিদার কারণে অবিক্রীত পণ্য মজুদ করতে বাধ্য হচ্ছে কারখানাগুলো। শিল্পোৎপাদন কার্যক্রমের পরিসংখ্যান ১৯ দেশের অঞ্চলটিতে মন্দার আশঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের শিল্পোৎপাদন খাতের চূড়ান্ত পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেকস (পিএমআই) জুলাইয়ে ৪৯ দশমিক ৮ পয়েন্টে নেমেছে। জুনেও এ পিএমআই ৫২ দশমিক ১ পয়েন্টে ছিল। এ নিয়ে ২০২০ সালের জুনের পর প্রথম অঞ্চলটির কারখানা কার্যক্রম সংকোচনের মধ্যে পড়ল। পিএমআই ৫০ পয়েন্টের নিচে সংকোচন এবং এর ওপরে ওই খাতের প্রসারণকে নির্দেশ করে।
গত মাসে চীনের শিল্পোৎপাদন কার্যক্রমও সংকুচিত হয়েছে। জুলাইয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির উৎপাদন খাতের এ হার ৪৯ পয়েন্টে নেমেছে। এটি গত তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। জুনেও দেশটির এ খাতের পিএমআই ৫০ দশমিক ২ পয়েন্টে ছিল।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের প্রধান ব্যবসায়িক অর্থনীতিবিদ ক্রিস উইলিয়ামসন বলেন, ইউরো অঞ্চলের উৎপাদন ক্রমবর্ধমানভাবে একটি খাড়া মন্দার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি অঞ্চলটির মন্দার ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলছে। অঞ্চলটির শিল্প খাতে নতুন ক্রয়াদেশও নিম্নমুখী রয়েছে। কভিডজনিত লকডাউনের মাসগুলো বাদ দিলে নতুন ক্রয়াদেশ ২০১২ সালের ঋণ সংকটের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যাশার তুলনায় বিক্রি কমে যাওয়ার বিষয়টি নতুন ক্রয়াদেশ ও রফতানির পতনকে প্রতিফলিত করছে। এ অবস্থায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত হওয়া অবিক্রীত পণ্যের মজুদ ব্যাপকহারে বেড়ে যাচ্ছে। গত মাসে ইউরো অঞ্চলের নতুন ক্রয়াদেশের পিএমআই ৪২ দশমিক ৬ পয়েন্টে নেমেছে। আগের মাসেও এ হার ৪৫ দশমিক ২ পয়েন্টে ছিল। জুলাইয়ের এ সূচক ২০২০ সালের মে মাসের পর সর্বনিম্ন। কভিডজনিত লকডাউনের কারণে অর্থনীতিজুড়ে স্থবিরতা দেখা দেয় এবং কারখানাগুলো উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়। ফলে সে সময় নতুন ক্রয়াদেশ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছিল। তবে শিল্প খাতের বর্তমানের এ পরিস্থিতি হঠাৎ করে ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনাও কম বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল জানিয়েছে, নেদারল্যান্ডস ছাড়া ইউরো অঞ্চলের সব দেশে উৎপাদন কার্যক্রম সংকুচিত হয়েছে। এমনকি এ পতনের হার জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোয় বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। এদিকে টানা দুই প্রান্তিক ধরে সংকোচনের মধ্যে রয়েছে মার্কিন অর্থনীতি। এ অবস্থায় বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি বেড়েছে। ফলে দেশটি থেকে শিল্প খাতের চাহিদায় পতন হয়েছে। এছাড়া রেকর্ড মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আক্রমণাত্মকভাবে সুদের হার বাড়াচ্ছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি বিশ্বজুড়ে সুদের হার বাড়াতে প্ররোচিত করছে। গত মাসে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকও প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হারে সুদের হার বাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের এ পদক্ষেপ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান সংস্থা ইউরোস্ট্যাট জানিয়েছে, ইউরো মুদ্রা ব্যবহার করা ১৯ দেশে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি জুলাইয়ে ৮ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। জুনে এ বাড়ার হার ছিল ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। তবে দ্বিতীয় প্রান্তিকেও এ অঞ্চলের অর্থনীতি আগের প্রান্তিকের তুলনায় দশমিক ৭ শতাংশ প্রসারিত হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পর্যটন খাত পুনরুদ্ধারের হাত ধরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আশাবাদী সংবাদের শেষ ঝলক হতে পারে। উচ্চমূল্যস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান সুদের হার এবং যুদ্ধের কারণে তীব্র জ্বালানি সংকট চলতি বছরের শেষ দিকে ইউরো অঞ্চলকে মন্দার দিকে ঠেলে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।