শীর্ষ ২০ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক। ঋণের অর্থও আদায় হচ্ছে না, আবার অর্থ আদায়ে দৃশ্যমান
কোনো ব্যবস্থাও নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে মন্দ ঋণের বোঝা চেপে বসেছে ব্যাংকটির ঘাড়ে।
দিনের পর দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা অব্যবস্থাপনা ও
অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে দেওয়া এসব ঋণ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবে বিদ্যমান
আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে অনিয়ম কিছুটা কমে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো,
বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক
ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘এটা অনেক পুরোনো
এবং পাতানো খেলা। এর সঙ্গে ব্যাংকের পর্ষদ, ব্যাংকার ও সরকার জড়িত। সব জায়গায় একটা
অসাধু চক্র থাকে। তারাই এই অপকর্ম করে। শুধু সোনালী ব্যাংক নয়, পুরো ব্যাংকিং খাতে
এ চিত্র। ঋণ পুনঃতপশিলের পাশাপাশি অর্থঋণ আদালতেও আটকে আছে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার
খেলাপি ঋণ। যদিও সব সময় বলে থাকি প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু
মামলা চলমান থাকায় এসব টাকাকে খেলাপি বলা যাচ্ছে না। পুরো টাকাই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
এ টাকা আদায়ের সম্ভাবনা নেই। তবুও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এসব টাকা আদায়ের চেষ্টা
করতে হবে।’
সোনালী ব্যাংকের হালনাগাদ এক প্রতিবেদন
অনুযায়ী ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৭২১
কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর মধ্যে শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছেই
পাওনা ৪ হাজার ৮৩ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপির ৩৮ শতাংশ। চলতি বছরে এসব বড় খেলাপির কাছ
থেকে ঋণ আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। কিন্তু জানুয়ারি
থেকে আগস্ট পর্যন্ত শীর্ষ ১৬ খেলাপি প্রতিষ্ঠান থেকে এক টাকাও আদায় হয়নি। এর মধ্যে
রয়েছে হলমার্ক গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের ৪৯০ কোটি
টাকা, মেসার্স হলমার্ক গ্রুপের ৪৮৪ কোটি টাকা, তাইপে বাংলা ফেব্রিক্সের ৩৩২ কোটি টাকা,
মেসার্স ফেয়ার অ্যান্ড ফেব্রিক্সের ৩১৬ কোটি টাকা, মেসার্স রহমান গ্রুপের ৩১৪ কোটি
টাকা, মেসার্স লীনা গ্রুপের ২১৫ কোটি টাকা, রতনপুর স্টিল রিরোলিং মিলসের ১৮২ কোটি টাকা,
মেসার্স মেঘনা কনডেন্স মিল্কের ১৩১ কোটি টাকা, মেসার্স সোনালী জুট মিলের ১২৭ কোটি টাকা,
মেসার্স এ কে জুট ট্রেডিংয়ের ১১৭ কোটি টাকা, মেসার্স ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের
১১৬ কোটি টাকা, মেসার্স সুপ্রিম জুট অ্যান্ড নিটেক্সের ১০৬ কোটি টাকা, মেসার্স ইস্টার্ন
ট্রেডার্স ৯৩ কোটি টাকা, ফারুক ডাইং নিটিং অ্যান্ড ম্যানুফেকচারিংয়ের ৯০ কোটি টাকা,
মেসার্স সানবীম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের ৮৬ কোটি টাকা এবং মেসার্স সাইয়ান করপোরেশনের
৭৬ কোটি টাকা। তবে এ সময়ে বাকি চার খেলাপি প্রতিষ্ঠান থেকে আদায় হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার
০.৪৩ শতাংশ মাত্র।
এদিকে ঋণ অবলোপন থেকে আদায় পরিস্থিতি আরও
খারাপ। সোনালী ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী শীর্ষ ২০ গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের ঋণ অবলোপন
করা হয়েছে ২ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে গত ৮ মাসে ১৮ প্রতিষ্ঠান এক টাকাও ফেরত
দেয়নি। বাকি দুই প্রতিষ্ঠান থেকে আগস্ট পর্যন্ত আদায় হয়েছে মাত্র ১৮ কোটি টাকা, যা
বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৬.৮৬ শতাংশ।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, বহুল
আলোচিত হলমার্ক গ্রুপের ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা অবলোপন করেছে সোনালী ব্যাংক। তবে গত
৮ মাসে আদায় হয়নি এক টাকাও। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল করপোরেট শাখা থেকে জালিয়াতি হওয়া
এসব টাকার পুরোটাই এখন আদায় অনিশ্চিত। নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স নিউ
রাখী টেক্সটাইল মিলসের ১২৩ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। এর বিপরীতে কোনো টাকাই ফেরত
আসেনি। কাগজে-কলমে রয়ে গেছে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা। চলতি বছরে এই গ্রাহক থেকে ১২ কোটি
টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সোনালী ব্যাংক। কিন্তু ৮ মাস পার হয়ে গেলেও
আদায়ের তালিকা শূন্য। এছাড়া আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স জাসমির ভেজিটেবল
অয়েলের অবলোপন ১০৬ কোটি টাকা। ১০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও জানুয়ারি
থেকে আগস্ট পর্যন্ত কোনো টাকা আদায় হয়নি। একই অবস্থা ৯৬ কোটি টাকা অবলোপন করা রমনা
করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স ফেয়ার এক্সপোর। কোনো টাকা ফেরত নেই। অবলোপনের এক টাকাও
ফেরত না দেওয়া গ্রাহকের তালিকায় আরও রয়েছে মেসার্স আলফা টোবাকো। যশোর করপোরেট শাখার
এই গ্রাহকের অবলোপনের পরিমাণ ৯৬ কোটি টাকা। ঢাকার স্থানীয় কার্যালয়ের গ্রাহক মেসার্স
ওয়ান স্পিনিং মিলসের অবলোপন করা হয়েছে ৯৪ কোটি টাকা। কিন্তু ফেরত আসেনি এক টাকাও। ফরিদপুর
শাখা মেসার্স রোকেয়া টেক্সটাইল মিলসের ৮৩ কোটি টাকা অবলোপন করা হলেও তিনি কোনো টাকা
ফেরত দেননি গত ৮ মাসে। নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স সাহিল ফ্যাশন লিমিটেড।
১৮ কোটি টাকা অবলোপনের বিপরীতে ৮ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও জানুয়ারি থেকে
আগস্ট পর্যন্ত কোনো টাকা আদায় নেই। আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার অপর গ্রাহক মেসার্স ইমাম
ট্রেডার্স। ৮০ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে এই গ্রাহকের। তবে আদায় হয়নি কোনো টাকা। এছাড়া
মেসার্স সুমি’স সোয়েটার, মেসার্স ইউনিটি নিটওয়্যার, মেসার্স সিদ্দিক
ট্রেডার্স, মেসার্স কেপিএফ টেক্সটাইল, মেসার্স মুন নিটওয়্যার, মেসার্স এআর খান সাইজিং
অ্যান্ড ফেব্রিক্স, মেসার্স সাহিল নিটওয়্যার, যাদু স্পিনিং মিলস এবং মাস্ক সোয়েটার
অবলোপন করা ঋণের কোনো টাকা ফেরত দেয়নি। তবে মেসার্স ইম্পেরিয়াল ডাইয়িং অ্যান্ড হোসিয়ারি
লিমিটেড এবং মেসার্স রিভারসাইড লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার লিমিটেড ফেরত দিয়েছে ১৮ কোটি
৭১ লাখ টাকা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের
ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আতাউর রহমান প্রধান
বলেন, ‘ছোট গ্রাহকের
ঋণ ফেরত আসছে। এছাড়া বড়দের মধ্যে একটি অংশ ভালো। এর বাইরে নতুন ঋণও নিয়মিত আছে। কিন্তু
পুরোনো এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা সবচেয়ে বিপজ্জনক। এটি সবাই জানেন। তবে ঋণ আদায়ে সব
ধরনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সংজ্ঞা নির্ধারণ নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ
ব্যাংক। এরপর হয়তো কোনো একটা সমাধান বেরিয়ে আসবে।’