একসময় দেশের মানুষের স্বপ্ন ছিল রেলে চড়ে
কক্সবাজার ভ্রমণে যাবেন। দীর্ঘদিনের সে স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। চট্টগ্রামের দোহাজারী
থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইনের কাজ শেষের পথে। অক্টোবরে শুরু হচ্ছে প্রথম ট্রায়াল।
নবনির্মিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ এখন
এ এলাকার দর্শনার্থীদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। খুব শিগগিরই এ পথে
ট্রেন চলবে। ঢাকা থেকে ট্রেনে চড়ে যাওয়া যাবে কক্সবাজারে। এ রেলপথ দেখতে প্রতিদিনই
মানুষের ভিড় থাকে। বিশেষ করে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রেলপথের সাতকানিয়া অংশে সাধারণ
মানুষের ভিড় দেখা যায়। দূর-দূরান্ত থেকেও অসংখ্য দর্শনার্থী আসেন, রেলপথ ধরে হাঁটেন।
বসে আড্ডাও দেন।
স্থানীয়রা জানান, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলসংযোগ
বহুল কাঙ্ক্ষিত। ট্রেন চালু হলে যোগাযোগের নতুন মাত্রা যোগ হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও
বিশেষ ভূমিকা রাখবে রেল যোগাযোগ। আর তাই ট্রেন চালু হওয়ার আগে এ রেললাইন স্থানীয়দের
কাছে অবসর সময় কাটানোর স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন বিকেলে রেল লাইন জমে উঠে দর্শনার্থীদের
ভিড়ে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সাতকানিয়া উপজেলার
কেরানীহাটের উত্তরে নতুন রেলপথে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানা বয়সী মানুষের ভিড়।
লোকজনের ভিড়কে কেন্দ্র করে রেল লাইনে ঝালমুড়ি ও বাদাম বিক্রেতাদেরও দেখা মিলে। অনেকেই
পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসেন। রেললাইনের ওপর বসে বাদাম খান আবার কেউ রেলপথে হেঁটে বেড়ান।
পরিবার ছাড়াও দলবদ্ধ হয়ে স্কুল-কলেজের বন্ধুরা, চাকরিজীবী, স্থানীয় বয়স্কদের হেঁটে
বেড়াতে দেখা যায়। সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত রেললাইনে দর্শনার্থীদের বেশ ভিড় থাকে।
বান্দরবান সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সাতকানিয়ার
বাসিন্দা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, নতুন রেললাইনে ঘুরতে এসেছি। বেশ ভালো লাগছে। অবসর সময়
কাটাতেই রেলপথ ধরে হাঁটছি। অনেক লোকজন আসছে।
শাহাব উদ্দিন নামে একজন বলেন, বিকেলে এখানে
প্রায়ই ঘুরতে আসি। বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক লোকজন ঘুরতে আসে এখানে। সূর্য ডোবার মুহূর্ত
রেললাইন থেকে বেশ ভালো লাগে।
তারেকুল ইসলাম ও গিয়াস উদ্দিন সানিম নামে
দুই যুবক বলেন, রেল চালু হলে তো আর এভাবে হেঁটে বেড়ানো যাবে না। আমাদের এখানে তেমন
দর্শনীয় স্থান নেই। এখন বিকেলের সময়টা রেলপথে ঘুরে বেড়াই। সময় কাটাই। ভালো লাগে। তাছাড়া
বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক লোকজন আসে। বিকেলে একপ্রকার মেলা মিলে যায়।
কেঁওচিয়ার নয়াপাড়া এলাকার বোরহান উদ্দিন
আজাদ বলেন, রেল চালু হলে নতুন দিগন্ত খুলবে যোগাযোগের। রেল ঘিরেও স্বপ্ন এ অঞ্চলের
মানুষের মনে। এখন এ রেললাইন মানুষের অবসর সময় কাটানোর স্থানে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য মানুষের
পদচারণা দেখা যায় বিকেল হলেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১৫
অক্টোবর প্রথম ট্রায়াল ট্রেন যাত্রা শুরু করবে বহুল কাঙ্ক্ষিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন
ধরে। কালুরঘাট সেতু পার করে ৬টি বগি ও ইঞ্জিন পটিয়ায় নিয়ে রাখা হয়েছে দেড় মাস আগেই।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, কক্সবাজার রুটে ট্রেন
চালুর পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ৬/১২ লোডের ২০১৯ সালে সুবর্ণ এক্সপ্রেসের
অবমুক্ত হওয়া একটি ট্রেন পটিয়াতে ট্রায়ালে ট্রেন হিসেবে অবস্থান করছেন। যেটি আগামী
অক্টোবরে কক্সবাজার অংশের কাজ শেষ হলে পটিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পুরো রেল সড়কে
চূড়ান্ত ট্রায়াল দিবে ৬টি বগি সম্বলিত এ ট্রেনটি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, দোহাজারী থেকে
কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন ও স্টেশনের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। কক্সবাজারে আইকনিক
স্টেশনে প্লাটফর্ম ও প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ প্রস্তুত করা হয়েছে। ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে
প্রায় ৯০ কিলোমিটার রেললাইনের কাজ শেষ হয়েছে। এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক
সহায়তায় এই রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। আগামী বছরের
জুন পর্যন্ত কাজের মেয়াদ ধরা হলেও ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজটি পুরোপুরি শেষ করতে চায় প্রকল্প
সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়,
১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার
রেললাইন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার
পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা। এর মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে
কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের প্রায় সাত বছর পর ২০১৮ সালে ডুয়েল
গেজ এবং সিঙ্গেল ট্র্যাক রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রথমে প্রকল্প ব্যয়
ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে
দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এতে অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)
ও বাংলাদেশ সরকার। এটি সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত।
অপরদিকে, গত ৭ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া ছয়
দিনের টানা বৃষ্টিতে ডুবে যায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলা।
এতে সাতকানিয়ার তেমুহনি এলাকায় ২৫০ মিটার রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেললাইন থেকে পাথর-মাটি
সরে যায়। এ কারণে দেবে যায় রেললাইনের বেশ কিছু অংশ। বন্যার পর ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন
সংস্কার করা হয়েছে।