জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বে স্বাধীনের ৩ বছরের মধ্যে ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম পুরোদমে চালু করেন। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০২১ ও ২০৪১ অর্জনসহ এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চট্টগ্রাম বন্দর বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। আগামী ২০৫০ সালের টার্গেট নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। তখন বন্দরের কার্যক্রম যেমন বাড়বে, তেমনি সক্ষমতাও অনেকগুণে বাড়বে। তাই স্মার্ট বন্দরের পথে অনেকদূর এগিয়েছে। পৃথিবীর সেরা সব বন্দরের মতো চট্টগ্রাম বন্দরও একই উচ্চতায় থাকবে।
মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল সাথে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, দেশে ও বিদেশে চট্টগ্রাম বন্দরের ভাবমূর্তি ও সুনাম অনেক বৃদ্ধি করেছেন। বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতাসম্পন্ন করা হয়েছে। ওয়ানস্টপ ভবনের কাজও চলমান, এটি হলে তখন এক জায়গা থেকে সব করা যাবে। আন্তর্জাতিকভাবে চট্টগ্রাম বন্দর আজ বহুল পরিচিত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহ। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে দেশের মোট বাণিজ্যের ৯২% এবং কন্টেইনারজাত পণ্যের ৯৮% পরিবাহিত হয়ে থাকে। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগই সামাল দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ পণ্য পরিবাহিত হয়ে এই বন্দর দিয়ে। দেশের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য চাহিদা, আঞ্চলিক যোগাযোগের ভৌগলিক অবস্থানগত গুরুত্ব এবং বলর কেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তা চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব বাড়ছে। সরকারও চট্টগ্রাম বন্দরের ধারাবাহিক উন্নয়নে তৎপর। ১০ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভেড়ানো, ইউরোপের সাথে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, বহির্নোঙরের আওতা বৃদ্ধি, ভিটিএমআইএস, ডিজিটালাইজেশন, কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের অত্যাধুনিক কী সাইড গ্যান্ট্রি ক্রেন সংযোজনের মতো উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে গত এক যুগে। এখন আঞ্চলিক পণ্য পরিবহনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া। কর্ণফুলী নদীতে অনেক বাঁক আছে। এটি প্রাকৃতিক চ্যানেল। কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্যতা বেড়েছে। কিন্তু সেখানে বর্জ্য একটি বড় সমস্যা। আমরা ড্রেজিং করে সেটাকে উপযোগী করেছি৷ আগামী বছরের মধ্যে ১১ মিটারের জাহাজ জেটিতে ভেড়ানো সম্ভব হবে। নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা, মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। কর্ণফুলী নদী রক্ষায় যা করা প্রয়োজন, সবই আমরা করবো।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রধান গেটওয়ে হিসেবে কাজ করছে।
কোভিড অতিমারি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির প্রত্যাশিত গতিকে মন্থর কমলেও চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে তেমন প্রভাব ফেলেনি বরং কার্গো হ্যান্ডলিং এবং আয় বেড়েছে। জুন মাসে এ বন্দর দিয়ে ৫০ শতাংশ রপ্তানি বেড়েছে, যার ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাক।
আমরা বন্দরের কাজকে সেবা হিসেবে নিয়েছি। চট্টগ্রাম বন্দরে দিন নেই, রাত নেই, শুক্রবার ছুটির দিন নেই। ২৪ ঘণ্টা সাত দিন সচল থাকে। আমাদের বন্দর সারা বিশ্বে সমাদৃত। বিভিন্ন দেশ ব্যাপক বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করছে। আগামী তিন বছরে ৫-৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আসবে বলে আশা করি। পৃথিবীর সব দেশের মতো অনেক বিদেশিরা এখানে বিনিয়োগ আগ্রহী। আমরা সবাই আসুক, কাজ করুক এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখুক। একই সাথে নতুন প্রযুক্তি আসবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। ডেনমার্কও বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন৷ লালদিয়ার চরের ৫২ একর ভূমি দখলমুক্ত করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, সেখানে জায়গা করে দিবো।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৪৪ টিইইউএস। জেনারেল কার্গো ওঠানামা হয়েছে ১১ কোটি ৮২ লাখ ৯৬ হাজার ৭৪৩ মেট্রিক টন। জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৪২৫৩ টি। প্রায় ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পেছনে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরবচ্ছিন্ন কর্মতৎপরতা ও দক্ষতা। আমদানিকৃত পণ্য দ্রুততর খালাস ও রপ্তানিযোগ্য পণ্য দ্রুত জাহাজীকরণে ভবিষ্যৎ চাহিদাকে সামনে রেখে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদী কার্গো ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সুবিধাদি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নতুন নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করছে। ইতোমধ্যে ৫৮৪ মিটার দীর্ঘ পিসিটি নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমান ও ভবিষ্যতে কন্টেইনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিং নিরবচ্ছিন্ন রাখার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন হেভি লিফট জেটি, বে-টার্মিনাল এবং কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় মাতারবাড়ী পোর্ট উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে । বে-টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান সক্ষমতা বহুগুনে বৃদ্ধি পাবে। কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্যতা বাড়াতে ৫১ লাখ ঘনমিটার পলি ও বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ডিসেম্বরে বন্দরের নতুন কেমিক্যাল শেড চালু করা সম্ভব হবে। পিসিটি পরীক্ষামূলক চলছে। বে টার্মিনাল ও ব্রেক ওয়াটারের ডিজাইনের কাজ চলছে। প্রশস্ত চ্যানেলে ১২-১৩ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ২৪ ঘণ্টা অপারেশন করা সম্ভব হবে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রথম জেটি নির্মাণের কাজ শুরু হবে। ১০-১২ হাজার কনটেইনার নিয়ে জাহাজ ভিড়তে পারবে। বড় জাহাজে পণ্য আনা হলে ভোক্তা পর্যায়ে সুবিধা পাবে।
বন্দর চেয়ারম্যান জানান, জাহাজ আগমনের সংখ্যা, লাইটার ভেসেলের কার্যক্রম বৃদ্ধি, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর বাস্তবায়নকে সামনে রেখে বর্হিনোঙরের আওতা ৬২ নটিক্যাল মাইলে উন্নীত করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রয়েছে অত্যাধুনিক ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ভিটিএমআইএস)। বন্দরের বহরে যোগ হয়েছে ৪টি অত্যাধুনিক টাগবোট, দুইটি মুরিং লঞ্চ, ২টি সাইড স্ক্যান সোনার, ২টি ইকো সাউন্ডার ও ১টি সি গোয়িং হারবার টাগবোট।
চট্টগ্রাম বন্দর একটি আইএসপিএস কমপ্লায়েন্ট বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরের সংরক্ষিত ও সংলগ্ন এলাকার প্রায় ৯৮ শতাংশ এখন সিসিটিভি মর্নিংটরিয়ের আওতায়। অত্যাধুনিক সিসিটিভি কন্ট্রোল সেন্টার থেকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে বন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিটে রয়েছে ফায়ার ফাইটিং ফোম টেন্ডার, রেসকিউ ভেহিক্যাল, রিকভারী ভেহিক্যাল। এছাড়া কেমিক্যাল ফায়ার ফাইটিংয়ের জন্য একটি হাজমত টেন্ডার, ২টি র্যাপিড ইন্টারভেনশন ফায়ার ফাইটিং ভেহিক্যাল ও ৪টি ফায়ার পিকআপ সংযোজনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ফায়ার হাইডেন্টের আওতায় আনা হচ্ছে পুরো বন্দর এলাকাকে। চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙরকে নিরাপদ বর্হিনোঙর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক পাইরেসি মনিটরিংকারী প্রতিষ্ঠান রিক্যাপ। লয়েডস লিস্টে ২০০৯ সালে ১৮তম হতে সম্প্রতি করোনার ধাক্কা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ সামলে ২০২৩ সালে এ তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর ৬৭ তম স্থানে অবস্থান করছে।
১৯৭৭ সালে ৬টি কন্টেইনার আগমনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং দিয়ে যাত্রা শুরু যা বর্তমানে সকলের অবদানে ৩ মিলিয়ন ক্লাবের গর্বিত অংশীদার।