দেশে ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন
(সামাজিক সংক্রমণ) শুরু হয়েছে। ১৫ থেকে ২০ শতাংশ করোনা রোগীই ওমিক্রনে আক্রান্ত বলে
জানিয়েছেন স্বাস্হ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। রাজধানী ঢাকা ও পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিকে
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত
করেছে স্বাস্হ্য অধিদপ্তর; মাঝারি মাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে সীমান্তবর্তী
ছয় জেলা।
গত এক দিনে মোট আক্রান্তের ৮৩ শতাংশই
ঢাকা বিভাগের। ওমিক্রন ঠেকাতে আজ বৃহস্পতিবার থেকে সারা দেশে কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন
করা হবে। ১১ বিধিনিষেধের মধ্যে উন্মুক্ত স্হানে রাজনৈতিক ও সামাজিক সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠানের
ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে গণপরিবহনে
অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল, মাস্কবিহীন চলাচলকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান এবং বিধিনিষেধ
কার্যকর করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকেরা বলেন, এই বিধিনিষেধ
বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করবে দেশের সংক্রমণ পরিস্হিতি। বিধিনিষেধ মানলে করোনা নিয়ন্ত্রণ
করা সম্ভব হবে। তবে না মানলে পরিস্হিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। হাসপাতালের ওপর চাপ বাড়বে।
রোগীরা ভোগান্তিতে পড়বে। চিকিত্সাসেবা পাওয়া তখন ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
টিকা নেওয়ার পাশাপাশি স্বাস্হ্যবিধি মানার বিধিনিষেধ কঠোরভাবে পালন করে সিঙ্গাপুর,
ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ কয়েকটি দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। দেশে যেহেতু
ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে, তাই স্বাস্হ্যবিধি না মানলে সামনে দ্বিগুণ
হারে সংক্রমণ বাড়বে। সরকার আগে নো মাস্ক, নো সার্ভিস চালু করেছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়নে
প্রশাসন সফল হয়নি। এখন যদি মাস্ক পরা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ৯০ ভাগ নিরাপদে থাকা যাবে।
মিল, কল-কারখানাসহ দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে। খেটে খাওয়া মানুষের ভোগান্তি কমবে।
করোনা ভাইরাসের ডেলটা ধরনের দাপটে গত
বছরের মাঝামাঝি সময়ে রোগীর চাপে দেশের স্বাস্হ্যব্যবস্হা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ঐ
সময় দৈনিক শনাক্ত রোগী ১৬ হাজারও ছাড়িয়ে যায়, এক দিনে আড়াই শতাধিক মানুষের মৃত্যুও
বাংলাদেশকে দেখতে হয়। গত নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া করোনা ভাইরাসের নতুন
ধরন ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকাতে আজ প্রথম পৃষ্ঠার পর প্রভাবে পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও
আবার শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
মাইলফলকে বাংলাদেশ পৌঁছাল, যখন করোনা
ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রভাবে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ফের বাড়ছে। স্বাস্হ্য
অধিদপ্তর জানিয়েছে, গতকাল বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২ হাজার ৯১৬ জনের
মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে, যা আগের দিনের চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি। এক দিনে এর চেয়ে বেশি
রোগী শনাক্ত হয়েছিল গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর, সেদিন ৩ হাজার ১৬৭ জনের মধ্যে সংক্রমণ
ধরা পড়েছিল। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে
১৬ লাখ ১ হাজার ৩০৫।
ওমিক্রন বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের
প্রস্ত্ততি জানিয়ে স্বাস্হ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের
সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ২০ হাজার শয্যা তৈরি রেখেছিল। আরো ২০ হাজার শয্যা প্রস্ত্তত
করা হচ্ছে। যদি ৪০ হাজার রোগী হয়, তাহলে রাখা যাবে। কিন্তু যদি ১ লাখ হয়, তাহলে কোথায়
থাকবে? এখন মৃত্যুর হার কম আছে, কারণ হলো টিকা নেওয়া আছে। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা
যদি তিন-চারগুণ হয়ে যায়, তাহলে বেকায়দায় পড়তে হবে। এখনই সতর্ক না হলে আক্রান্তের সংখ্যা
আরো বাড়বে। সে ক্ষেত্রে হাসপাতালে জায়গা দিতে সমস্যা হবে। আমরা ধরে নিই, ৫ শতাংশের
হাসপাতালে আসতে হয়। এরই মধ্যে হাসপাতালে রোগী আসা শুরু হয়ে গেছে। আমরা দেখব, আগামী
পাঁচ-সাত দিনের মধ্যেই অনেক রোগী হয়ে যাবে হাসপাতালে। তখন আবার একটা কষ্টকর অবস্হা
তৈরি হবে। হাসপাতালে প্রেশার পড়বে, চিকিত্সক-নার্সদের ওপর প্রেসার পড়বে। সিট পেতে
সমস্যা হবে, মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারঘোষিত বিধিনিষেধ
কঠোরভাবে পালন করতে হবে। এটা বাস্তবায়নের ওপরই দেশে সংক্রমণ পরিস্হিতি কোন দিকে যাবে,
সেটা নির্ভর করছে। বিধিনিষেধ না মানলে চিকিত্সাসেবা প্রদান কঠিন হবে, দেশের অর্থনীতির
চাকা সচল রাখা যাবে না। তিনি বলেন, স্বাস্হ্যবিধি মানানোর বিষয়টি শুধু সরকারের একার
দায়িত্ব নয়। প্রশাসন, স্হানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সর্বস্তরের মানুষকে এক্ষেত্রে সচেতন হতে
হবে।
বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্হার দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, দেশে করোনার সংক্রমণ
এখন বাড়তেই থাকবে। জনগণকে স্বাস্হ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। এজন্য কঠোর হতে হবে।
অতীতে সরকার ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ চালু করেছিল।
কিন্তু প্রশাসন এক্ষেত্রে সফল হয়নি। স্বাস্হ্যবিধি মানতে কঠোর না হলে দেশের হাসপাতালের
ওপর চাপ বাড়বে। রোগীরা চরম ভোগান্তিতে পড়বে। দেশে ৭০ শতাংশ চিকিত্সা খরচ জনগণের
নিজের পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়। দেশে করোনার সংক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়লে চিকিত্সার
বাইরে থাকবে সিংহভাগ মানুষ। সরকারের ১১ বিধিনিষেধ বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে দেশের
করোনা পরিস্হিতি কোন দিকে যাবে। এক্ষেত্রে ঢিলেঢালা ভাব দেখানো যাবে না। তিনি বলেন,
জেলা-উপজেলায় যে যেখানে আছে সেখানে যেন চিকিত্সাসেবা নিতে পারে, সেই ব্যবস্হা করতে
হবে। উপজেলা হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
স্বাস্হ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ)
অধ্যাপক ডা. নাজমুল হক বলেন, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের যেসব দেশ শতভাগ
স্বাস্হ্যবিধি মেনে চলেছে, জনগণকে মানাতে বাধ্য করাতে পেরেছে এবং যারা টিকা নিয়েছে,
তারা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। আমরা যদি সরকারঘোষিত ১১ বিধিনিষেধ মেনে চলি, তাহলে
সফল হব। আর না মানলে সামনে বিপদ।
সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনায় সারা দেশকে
লাল, হলুদ ও সবুজ- এই তিন ভাগে ভাগ করেছে স্বাস্হ্য অধিদপ্তর। লাল রংকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ,
হলুদকে মধ্যম এবং সবুজকে কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
স্বাস্হ্য অধিদপ্তর বলছে, উচ্চ ঝুঁকির
এলাকা ঢাকা ও রাঙ্গামাটি জেলায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১০ শতাংশ থেকে
১৯ শতাংশের মধ্যে। ইয়েলো জোন, অর্থাৎ মধ্যম মাত্রার ঝুঁকিতে থাকা রাজশাহী, রংপুর,
নাটোর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, যশোরে শনাক্তের হার এখন ৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে।
আর সংক্রমণের হার শূন্য থেকে চার শতাংশের
মধ্যে রয়েছে এমন ৫৪টি জেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে সবুজ রঙে। এই জেলাগুলো হলো- চট্টগ্রাম,
বগুড়া, গাজীপুর, কক্সবাজার, কুষ্টিয়া, নীলফামারী, বরগুনা, শেরপুর, মেহেরপুর, ঠাকুরগাঁও,
ফেনী, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, পিরোজপুর, বাগেরহাট, নারায়ণগঞ্জ, নওগাঁ, ঝালকাঠি, খুলনা,
পটুয়াখালী, কুড়িগ্রাম, জয়পুরহাট, ফরিদপুর, বরিশাল, চুয়াডাঙ্গা, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর,
লক্ষ্মীপুর, ময়মনসিংহ, রাজবাড়ী, সিলেট, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নোয়াখালী,
কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধা, শরীয়তপুর, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, খাগড়াছড়ি, ঝিনাইদহ, পাবনা,
মাদারীপুর, মাগুরা, সুনামগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, নেত্রকোনা, ভোলা, টাঙ্গাইল,
হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নড়াইল।
এদিকে গত এক দিনে আরো চার জনের মৃত্যু
হয়েছে, তাদের মধ্যে ২৮ হাজার ১১১ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনা ভাইরাস। গত এক দিনে
দেশে মোট ২৪ হাজার ৯৬৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, তাতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে
১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
এর আগে গত বছরের ৩১ আগস্ট নমুনা পরীক্ষার
বিপরীতে শনাক্তের হার এর চেয়ে বেশি ছিল। সেদিন প্রতি ১০০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১১ দশমিক
৯৪ জনের কোভিড পজিটিভ এসেছিল। দেশে এখন সক্রিয় কোভিড রোগীর সংখ্যা ২১ হাজার ৫৪১
জন। দেশে প্রথমবারের মতো ঢাকার বাইরে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের রোগী শনাক্ত
হয়েছে; যশোরের এ তিনজনসহ দেশে সরকারি হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৩৩।