কবি ও প্রাবন্ধিক অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘আর-সব কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নি কো নজরুল’। সত্যিই তাই। ধর্ম-বর্ণ কিংবা জাতভেদ দিয়ে তাঁকে বিভক্ত করা যায়নি। এ দেশের মানুষের কাছে নজরুল যেমন বরণীয়, ভারতের জনগণের কাছেও তেমনি স্মরণীয়। এর কারণ তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবোধ। ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন,- ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ মানবতা ও সাম্যের জন্য তিনি ছিলেন এমনই সোচ্চার।
দ্রোহ ও প্রেম, কঠোরে কোমলে অম্লান কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ । আমাদের জাতীয় কবি, আবালবৃদ্ধবনিতার প্রিয় নজরুল। সারা দেশে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দিনটি পালিত হবে উৎসবমুখর আয়োজনে।
স্বাধীনতার পর কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি সম্মান জানাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে সপরিবারে কলকাতা থেকে ঢাকায় এনে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র কবি চিরবিদায় নিলে তাঁর গানে প্রকাশিত আকুতি মেনেই তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। নজরুলের সেই গানটি হলো ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই’। ‘চির উন্নত মম শির’ বলে কাজী নজরুল ইসলাম সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। নির্ভীকচিত্তে গেয়েছেন মানবতার জয়গান। দারিদ্র্যের কশাঘাত সহ্য করেছেন, ভোগ করেছেন নির্যাতন-নিপীড়ন; কিন্তু ব্যক্তিগত লোভ-লাভ-খ্যাতির মোহের কাছে কখনো আত্ম-বিক্রি করেনি। নিজের বিশ্বাস ও চেতনার জায়গায় থেকে গেছেন অনড়, থেকে গেছেন আপসহীন।
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৫ মে, ১৮৯৯) কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। পিতা কাজী ফকির আহমেদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। শৈশব থেকেই অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। জীবিকার দায়ে ঠেকেছিলেন শৈশবেই। লেটো দলের বাদক, রেল গার্ডের খানসামা, রুটির দোকানের শ্রমিক—এভাবেই পেরিয়ে গেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। ঘটনাবহুল ছিল তাঁর জীবন। পরে কাজ করেছেন সৈনিক হিসেবে। সাংবাদিকতা করেছেন। কাজ করছেন এইচএমভি ও কলকাতা বেতারে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছেন। পাশাপাশি সাহিত্য সাধনা তো ছিলই। শাসকের কোপানলে পড়েছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন, কিন্তু নত হয়নি নজরুলের উচ্চ শির।
কাজী নজরুল ইসলাম গত শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে অবিভক্ত বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের এক বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব। অনুকরণ ও অনুসরণের ধারা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন ধারায় শাণিত করেছিলেন। একইভাবে বাংলা গানের ক্ষেত্রেও তিনি নতুন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন। উত্তর ভারতীয় রাগসংগীতের দৃঢ় ভিত্তির ওপর রচনা করেছিলেন আধুনিক বাংলা গানের সৌধ। প্রবর্তন করেছিলেন বাংলা গজল। নজরুল তাঁর কবিতায়, গানে, উপন্যাসে পরাধীন ভারতে বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলায় সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন সব সময়। ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে তিনি জাগিয়ে দিয়েছিলেন পরাধীন ভারতবাসীকে। তাঁর উচ্চারিত বিদ্রোহের পঙ্ক্তিমালা অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দুন্দুভি বাদনে আজও অক্লান্ত। তাঁর কবিতা ‘চল্ চল্ চল্’ বাংলাদেশের রণসংগীত। বাংলায় সর্বোচ্চসংখ্যক তিন সহস্রাধিক গানের রচয়িতা কাজী নজরুল ইসলাম।
এসব সত্ত্বেও নজরুল ইসলাম অগণিত মানুষের বিপুল ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার আসনে আসীন হয়েছিলেন তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও নির্যাতিত-নিপীড়িত মানবতার প্রতি গভীর দরদের জন্য। তিনি মানুষকে জাগিয়েছেন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, শোষণের শৃঙ্খল ভাঙার আন্দোলনে। এখানেই তিনি সমকালের দাবি মিটিয়েও চিরকালীন।