বাঙালি জাতির যাত্রাপথ যেমন সহজ ছিল না কখনোই,
তেমনি আওয়ামী লীগের পথচলাও ছিল সবসময় দুর্গম। দেশভাগের পর বাঙালি জাতির ন্যায্য অধিকার
প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে যখন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হলো, তখন সারা দেশ চষে বেড়িয়ে দলকে
গণমানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান। দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের পোস্টারে
পরিণত হন তিনি। ফলে পাকিস্তানিরা তার ওপর জেল-জুলুম-নির্যাতন চালাতে থাকে। তবুও কখনোই
দমে যাননি তিনি।
এমনকি ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী
লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের মহাবিজয়ের পর আওয়ামী লীগকে নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় পাকিস্তানিরা।
যার ফলে ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক শাসন জারির সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা
হয়। মূল উদ্দেশ্য গণমানুষের দলে পরিণত হওয়া আওয়ামী লীগকে স্তব্ধ করে দেওয়া। একারণে
রাজনীতি নিষিদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে আবারো আটক করা হয় আওয়ামী লীগের মধ্যমণি শেখ মুজিবুর
রহমানকে।
বর্ষীয়ান নেতারা এসময় স্বৈরাচার আইয়ুব খানের
চাপে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার মুচলেকা দিতে বাধ্য হন। এরপর মূলত ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী
লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবকে কখনো জেলে, কখনো গৃহবন্দি, কখনো এক মামলা থেকে
থেকে মুক্তি দিয়ে আরেক মামলায় গ্রেফতার করে জান্তারা। ফলে এই দীর্ঘ সময় কার্যত নিষ্ক্রিয়
হয়ে পড়ে দলীয় কার্যক্রম।
তবে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর, ১৯৬৪ সালের
২৫ জানুয়ারি নিজের বাসভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠক ডাকেন শেখ মুজিবুর
রহমান। তার ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় আয়োজিত কেন্দ্রীয় নেতাদের সেই বৈঠকে আবারো
আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করার ঘোষণা দেন তিনি। প্রায় পাঁচ বছরের অচলাবস্থা কাটিয়ে
তেজস্বী পুরুষ শেখ মুজিবের হাত ধরে আবারো রাজপথে নেমে আসে আওয়ামী লীগ।
এরপর সারা দেশের প্রতিটি প্রান্তে সফর করে
তৃণমূল নেতাকর্মীদের সক্রিয় করে তোলেন তিনি। স্বৈরাচার আইয়ুববিরোধী আন্দোলন জোরদার
হয়ে ওঠে শেখ মুজিবের সাহসী নেতৃত্বে। ফলে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানি জান্তারা আবারো জেলে
নেয় তাকে। বের হওয়ার পর ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে আয়োজিত বিরোধী দলগুলোর
এক সম্মেলনে 'আমাদের বাঁচার দাবি' শিরোনামে 'ছয় দফা' পেশ করেন তিনি। এই দাবির সমর্থনে
গণজোয়ার সৃষ্টি হয় বাংলার মাটিতে।
এই তীব্র গণজোয়ারের মধ্যেই উপমহাদেশের বৃহত্তর
রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন সাবেক তুখোড় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর
রহমান। ছয় দফার প্রচারে তিন মাসে ৩২টি জনসভা করার পর, ৮ মে চূড়ান্তভাবে গ্রেফতার করা
হয় তাকে। ৭ জুন ছয় দফার সমর্থনে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে রাজপথে দুর্বার আন্দোলন
গড়ে ওঠে। শেখ মুজিব, ছয় দফা, আওয়ামী লীগ ও বাঙালির অধিকার- একে অপরের পরিপূরক হয়ে যায়
এসময়।
বঙ্গবন্ধু যে সময়টায় আওয়ামী লীগের পুনর্জীবন, ছয় দফা ঘোষণা ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত সময় পার করছেন; ঠিক এই দশক জুড়েই ছাত্র রাজনীতির হাতেখড়ি হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার। আজিম গার্লস স্কুলে মাধ্যমিক শিক্ষা এবং উচ্চমাধ্যমিকে বকশীবাজার সরকারি মহিলা কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা কলেজ)-থেকে ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে ছাত্রী সংসদের নির্বাচিত ভিপি হিসেবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। এরপর ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সক্রিয়ভাবে ছয়-দফার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।