গত ৩০ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের
প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। এদিন ৩০০ আসনের
জাতীয় নির্বাচনের জন্য দুই হাজার সাতশর বেশি প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা
দিয়েছেন। এখন চলছে যাচাইবাছাইয়ের কাজ।
কী কী কারণে নির্বাচনে প্রার্থিতা বাতিল
হতে পারে তা নিয়ে শনিবার (২ ডিসেম্বর) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনী বিধিমালার
নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনুসরণ না করলে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর কিংবা ‘বৈধ প্রার্থী’ হিসেবে গণ্য
হলেও তার প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনে
প্রয়োজনীয় তথ্য এবং আনুষঙ্গিক বিষয়সহ মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার মাধ্যমে আগ্রহী ব্যক্তি
নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রার্থিতা চাইতে পারেন।
তবে যাচাইবাছাই পর্যায় শেষ করে যখন তিনি
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য উপযুক্ত হিসেবে ছাড়পত্র পাবেন, তখনই তিনি প্রার্থী
হিসেবে গণ্য হবেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য যারা
কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছে তাদের মধ্য থেকে যাচাইবাছাই প্রক্রিয়ার ধাপ শেষে নির্বাচনের
জন্য যোগ্য হিসেবে মনোনীত হওয়া ব্যক্তিরাই হবেন ‘বৈধ প্রার্থী’, অর্থাৎ নির্বাচনে
জয়ের জন্য তারা প্রতিযোগিতা করতে পারবেন।
সংবিধানের অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে নির্বাচন
করার জন্য নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হয়। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ১ ও ২ ধারা অনুযায়ী
নির্বাচনে দাঁড়াতে হলে প্রার্থীকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং বয়স ২৫ বছরের
বেশি হতে হবে।
নির্বাচনে প্রার্থীকে কী ধরনের আচরণবিধি
মেনে চলতে হবে সে বিষয়ে ২০০৮ সালে আইনের একটি গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। পরে
সময়ে ২০১৩ ও ২০১৮ সালে এতে কিছু সংশোধন আনা হয়।
এতে প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ
করে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আদালত থেকে কোনো ব্যক্তি যদি ‘অপ্রকৃতিস্থ’ বলে ঘোষিত হন,
তবে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
এ ছাড়াও কেউ যদি বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিক
হন বা আনুগত্য স্বীকার করে তবেও তিনি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অযোগ্য বলে বিবেচিত
হবেন।
এই গেজেটে একজন প্রার্থী কী কী করলে নির্বাচনী
আচরণবিধি লঙ্ঘন হবে সে বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মনোনয়নপত্রের
সঙ্গে জামানতের টাকা, হলফনামা বা নির্দিষ্ট সংখ্যক সমর্থক না থাকার মতো বিষয়গুলো রয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের নিয়ম অনুযায়ী মনোনয়নপত্র
জমা দেওয়ার সময় ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কমিশনে জামানত হিসেবে জমা দিতে হয়।
কিন্তু কোনো প্রার্থী যদি মনোনয়নপত্রের
সঙ্গে সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জামানত হিসেবে না দেয় তবে যাচাইবাছাই পর্যায়েই তার
প্রার্থিতা বাতিল হবে।
এ ছাড়া মনোনয়নপত্রের সাথে প্রার্থীর নাম,
পিতা-মাতার নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, প্রস্তাবকের নাম, সমর্থকের নাম, প্রস্তাবক
ও সমর্থকের স্বাক্ষর, তিনি হলফনামা যথাযথভাবে পূরণ করেছেন কি না, প্রার্থীর নামে কোনো
ফৌজদারি মামলা আছে কি না এবং প্রার্থী ও তার পরিবারের সদস্যদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির
বিবরণ সংযুক্ত করতে হয়।
কেউ যদি হলফনামার সঙ্গে চাওয়া এই ৮টা তথ্য
ঠিকভাবে না দিতে পারেন, তাহলেও তার প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে।
তবে সমর্থকের ভোটার নাম্বার ভুলের মতো
ছোটখাটো ভুল ত্রুটির জন্য রিটার্নিং অফিসার প্রার্থিতা বাতিল করবেন না। সেক্ষেত্রে
মনোনয়ন জমা দেওয়া ব্যক্তিকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।
এ ছাড়াও নতুন নিয়মে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের
সঙ্গে আয়কর সনদ জমা দিতে হবে। এটি না দিলে মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে।
তথ্য ভুল হলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার
জন্য কোনো ব্যক্তি যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র কেনেন তবে তাকে বিশেষ
নিয়ম অনুসরণ করতে হয়।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা
দেওয়া ব্যক্তি যদি আগে কখনো নির্বাচিত হয়ে থাকেন, তবে কেবল গ্যাজেট জমা দিলেই হবে।
কিন্তু প্রথমবারের মতো নির্বাচনে এলে তাকে
ওই এলাকার মোট ভোটারের এক শতাংশ ভোটারের সমর্থনযুক্ত স্বাক্ষর জমা দিতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব
জেসমিন টুলি বলেন, কোন এলাকায় তিন লাখ ভোটার থাকলে তিন হাজার ভোটারের সমর্থনযুক্ত স্বাক্ষর
জমা দিতে হবে। কেউ যদি তার বদলে সাতাশশ জনের স্বাক্ষর জমা দেয় বা একটাও কম হয় তাহলে
তার মনোনয়নপত্র বাতিল হবে।
যাদের সমর্থনযুক্ত স্বাক্ষর জমা দেয়া হয়,
যাচাই করার সময় ১০টি ক্রমিক নম্বরের বিপরীতে যে কোনো ১০টি নাম দেওয়া হয়।
যাচাইবাছাইয়ের সময় যদি এদের মধ্যে কাউকে
পাওয়া না যায় কিংবা যার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে তিনি যদি স্বাক্ষর দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার
করেন তাহলেও মনোনয়ন জমা দেয়া ব্যক্তির প্রার্থিতা বাতিল হবে।
নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বলেন,
এমন যদি দেখা যায়, এক ব্যক্তি দুইজন প্রার্থীর সমর্থনে স্বাক্ষর করেছেন তবে দুইজনেরই
প্রার্থিতা বাতিল হবে।
ঋণ ও বিল খেলাপি হলে নির্বাচনী বিধিমালা
অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু শর্তের মধ্যে পড়লে ব্যক্তি প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য হিসেবে পরিগণিত
হন।
টুলি বলেন, কেউ যদি ঋণখেলাপি হন, তারপর
সাজাপ্রাপ্ত হন বা ইউটিলিটি বিল বাকি আছে এমন হয়, তাহলে তার মনোনয়নপত্র বাতিল হবে।
যেমন কোনো ব্যক্তি নৈতিক স্খলনজনিত কারণে
কোনো ফৌজদারি অপরাধে যদি দোষী সাব্যস্ত হন এবং শাস্তিস্বরূপ কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ড
পান তবে কারাভোগের পর পাঁচ বছর সময় পর্যন্ত তিনি প্রার্থী হতে পারবেন না।
এ ছাড়া ব্যাংকের ঋণখেলাপি হলে তা থেকে
অব্যাহতি না পাওয়া পর্যন্ত এবং কোনো ধরনের বিল যদি বকেয়া থাকে তাহলেও ওই ব্যক্তি প্রার্থী
হতে পারবে না।
প্রার্থী হওয়ার আগে মনোনয়ন পর্যায়ে মূলত
এই কারণগুলোর ফলেই মনোনয়ন জমা দেয়া একজন ব্যক্তির প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। তবে ‘বৈধ প্রার্থী’ হিসেবে মনোনয়ন
পাওয়ার পরও প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের কারণেও প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে।
আচরণবিধি লঙ্ঘন সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক
দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী প্রার্থীকে দেয়ালে পোস্টার লাগানো থেকে শুরু
করে ভোটারদের অর্থ প্রদান বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না মানাসহ বেশ কিছু নিয়মের কথা বলা
হয়েছে।
কোনো প্রার্থী যদি এই বিষয়গুলো অনুসরণ
না করেন তবে নির্বাচন কমিশনার চাইলে তার প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবেন।
আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ২০২২ সালে ঝিনাইদহ
পৌরসভার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আবদুল খালেকের মনোনয়নপত্র বাতিল করে
নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়াও স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও প্রার্থিতা বাতিলের কিছু উদাহরণ
আছে, কিন্তু তার নজির কম।
প্রার্থিতা বাতিল হলে করণীয় যাচাইবাছাই
প্রক্রিয়ার পর রিটার্নিং অফিসার যদি কারও প্রার্থিতা বাতিল করে তবে এর প্রতিকারে নির্দিষ্ট
সময়ের মধ্যে মনোনয়ন না পাওয়া ব্যক্তি নির্বাচন কমিশনে আবেদন করতে পারবেন।
সেখানেও ফলাফল তার বিপরীতে গেলে তিনি চূড়ান্ত
নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে যেতে পারবেন। ২০১৮ সালে বিএনপি নেতা বেগম খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা
বাতিল করার পর আদালতে গেলেও সেই রায় বহাল থাকার উদাহরণ দেন এই বিশ্লেষক। একই বিষয় প্রার্থী
হওয়ার পরও প্রযোজ্য।
সেক্ষেত্রে প্রথমেই প্রার্থিতা বাতিল করা
হয় না উল্লেখ করে সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা মিজ টুলি বলেন, প্রথমে সতর্ক করা হয়। তারপর
শোকজ করা হয়।
টুলি বলেন, ইলেকশন কমিশন যদি প্রার্থিতা
বাতিল করে গেজেট ঘোষণা করে দেয়, তবে তার জন্য কোর্ট খোলা আছে। চাইলে সে আদেশের বিরুদ্ধে
কোর্টে যেতে পারবে।