একটা মাত্র
মাটির কুঁড়ে ঘর, সে মাটির কুঁড়ে ঘরটিতেও আবার পুরাতন ফোঁটো টিনের চাল। পলিথিনের কাগজ
দিয়ে ঢেকে কোন রকমে শীত ও বৃষ্টির পানি ঠেকানোর চেষ্টা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান সাথে
যুদ্ধ করে কোন রকমে বেঁচে থাকার জন্য অসহায় জীবনযাপন করছে শ্রবণ প্রতিবন্ধী অসহায় এক
বৃদ্ধা মা। তারপরও বসবাসের অনুপযোগী সেই কুঁড়ে ঘর থেকে নির্যাতনের পর দুই
ছেলে তাড়িয়ে দিলেন গর্ভধারিণী মাকে। তাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে কয়েক দিন ধরে ঘর ছাড়া
অবহেলিত মা। ঘটনাটি ঘটেছে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার রায়েরচালা এলাকায়। ওই অসহায়
শ্রবণ প্রতিবন্ধী বৃদ্ধা মা হলেন, কালিয়াকৈর উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের রায়েরচালা এলাকার
মৃত আবুল কাশেম আলীর স্ত্রী রহিমা বেগম (৯০)। তিনি একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী।
এলাকাবাসী ও
ভুক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা গেছে, যখন মা বৃদ্ধ অসহায় হয়ে পরে, তখন থেকে ছেলেরা মাতার
ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেননি। এমন কি মায়ের সাথে সব সময় দুর্ব্যবহারসহ করতে থাকে নানা
ধরণের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনও।
এসব রোধে যদিও
পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ না করলে সন্তানদের জেল ও জরিমানার বিধিমালা রয়েছে। এরপরও থামছে
না পিতা-মাতার ওপর অন্যায় অত্যাচার ও নির্যাতন। জানাচ্ছিলাম কালিয়াকৈর উপজেলার রায়েরচালা
এলাকার শ্রবণ প্রতিবন্ধী অসহায় বৃদ্ধা রহিমা বেগমের অবহেলিত জীবন কাহিনীর কথা। শুধু
মাত্র সরকারী সুবিধা বলতে কয়েকটি টাকা বয়স্ক ভাতা পান তিনি। এছাড়া তার স্বামী মারা
গেছেন অনেক আগেই। স্বামীর মৃত্যুর পর ভরসার জায়গায়টা ছিল আব্দুল আজিজ ও খোকন মিয়া গর্ভে
ধরা দুই সন্তান। তাদের আকড়ে ধরেই শেষ জীবনটা পারি দিতে চেয়েছিলেন মা রহিমা। বড় আদরের
ছেলে গুলোকে অনেক যাচাই বাছায়ের মাধ্যমে সখ করেই বিয়ে দিয়ে ছিলেন ভাল মেয়ে দেখে।
আশা ছিল সন্তান,
ছেলের বউ ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে জীবনের বাকিটা সময় হাসি খুশিতেই পার করবেন। কিন্তু কে
জানতেন এত আশা বাঁধা মায়ে জীবনে নেমে আসবে অসহায় জীবন-যাপনের কালো অন্ধকার। শেষ সময়ে
সন্তানদের নির্যাতনের শিকার হতে হবে তাকে! কে জানতো? তার ছেলেদের ছলনার কথা। কৌশল ও
চুরি করে তার শেষ সম্বল মাথা গোজার কুঁড়ে ঘর নির্মিত জমি টুকু লিখে নিবে ছেলে খোকন।
সেই কুঁড়ে ঘরটি আজ কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও ঘরে খাবার নেই, টিনের চালের মর্চা ও ফোঁটোতে
পলিথিন কাগজ দিয়ে ঢেকে কোনো রকমে শীত ও বৃষ্টির পানি ফেরানোর চেষ্টা করছেন বৃদ্ধা মা
রহিমা বেগম। কিন্তু গত সোমবার সকালে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শ্রবণ প্রতিবন্ধী সেই
বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ছোট ছেলে খোকন ও তার বউ শাহিদা বেগম। এমন কি বসবাসের
অনুপযোগী মায়ের সেই কুঁড়ে ঘরটিও ভাংচুর করা হয়। শীত ও বৃষ্টির পানি ফেরানোর সেই টিনের
চালের পলিথিনের কাগজও ছিড়ে ফেলা হয়েছে। কুঁড়ে ঘর থেকে বৃদ্ধা মাকে তাড়িয়ে দিলে বাধ্য
হয়েই তিনি পাশের হাটুরিয়াচালা এলাকায় তার বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এখানেই যেন শেষ নয়
তার ওপর নির্যাতন, মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের খবর পেয়ে ছুটে যান বড় ছেলে আজিজ। সেও
অত্যাচারী কম নয়, এর পূর্বে মাকে উল্টো পাল্টা
বুঝিয়ে ভরণ পোষণের লোভ দেখিয়ে মাকে দিয়ে জমি বিক্রি করান। পরে বিক্রিত জমির টাকা
হাতিয়ে নেন বড় ছেলে আজিজ। এখন দরদ যেন উতলিয়ে পড়েছে। মাকে জোর পূর্বক ছোট ভাইয়ের
নামে থানায় অভিযোগ দেয়ার জন্য চাপ দেন। ছোট ছেলের নামে থানায় অভিযোগ দিতে অস্বীকার
করলে মাকে গালিগালাজসহ চরথাপ্পর দেন বড় ছেলে আজিজ। পরে বাধ্য হয়েই পরের দিন মঙ্গলবার
কালিয়াকৈর থানা একটি অভিযোগ করেন শ্রবণ প্রতিবন্ধী অসহায় মা।
অসহায় মায়ের
সাথে কথা বললে কাঁদতে কাঁদতে বৃদ্ধা মা রহিমা বেগম বলেন, আমি কেস করেছি, তারে (ছোট
ছেলেকে) ধইরা নিবা কিন্তু পোলাডারে মাইরো না, বাবা। আমার বোনের জায়গা লিখে নেওয়ার সময়
ছোট পোলায় চুরি কইরা আমার জমিও নিয়ে নিছে। আরেক পাশে জমি বিক্রি কইরা টাকা-পয়সা বড়
পোলায় নিয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন,
এখন আমি অন্যের কাছে চায়া-চুয়ে খাই। সেই মানুষে কিছু কিছু টাকা দিলে ঘরে রাখি। হেই
টাকা ছোট পোলা ও তার বউ চুরি কইরা নিয়া যায়। টাকার কথা কইছি দেইখা আমার ঘর ভেঙ্গছে,
আমারে বের কইরা দিছে। আমি কয়দিন মানুষের বাড়ি দৌড় পারুম। কেমনে দিবা বাবা, আমি তা বুঁঝি
না, আমার জমি ও ঘর ফেরত চাই।
অভিযুক্ত ছোট
ছেলে খোকন মিয়া বলেন, আমার হার্ড ও লিভারে সমস্যা, চিকিৎসায় অনেক খরচ হচ্ছে। মায়রে
কেমনে দেখভাল করুম। আমারে ও বউরে চোর কইছে বলে মায়ের লগে এমন ঘটনা ঘটেছে। মায়ে যে ঘরে
থাকে, সেটা আমার ঘর। আর আমি জমি ফেরত দিবো না।
ছোট ভাই চুরি
করে মায়ের পৌনে ৩ শতাংশ জমি নিয়েছে জানিয়ে বড় ছেলে আব্দুল আজিজ বলেন, আমি মায়রে মারি
নাই, তারে ধাক্কাইয়া নিয়া আইছি। আর অপর পাশের পৌনে ৩ শতাংশ জমি বেঁচে মা নিজেই দু-ভাইরে
ভাগ করে দিয়েছে।
কালিয়াকৈর থানাধীন
মৌচাক পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (ওসি) শহিদুল ইসলাম জানান, এ ঘটনায় থানায় একটি অভিযোগ হয়েছে।
বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী
কর্মকর্তা তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ জানান, আমরা জানতে পারলাম যে ওই বৃদ্ধ
মাকে তার সন্তান জোরপূর্বক ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। এ বিষয়টি অত্যান্ত গুরুত্ব সহকারে
দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।