পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার তোড়িয়া ইউনিয়নের দ্বারখোর সীমান্ত এলাকার নাগর নদ থেকে উদ্ধার মৃত চিতাবাঘটিকে হত্যা করা হয়েছে– প্রাথমিক তদন্তে এই তথ্য উঠে এসেছে। তবে হত্যাকাণ্ডের ধরন নিয়ে মতপার্থ্যক রয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে মৃত্যুর আসল কারণ যাবে বলছেন তারা।
শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) বাঘটিকে মৃত অবস্থায় উদ্ধারের পর বন বিভাগ থেকে জানানো হয়, তাদের ধারণা বাঘটি ভারত থেকে এসেছে। বাঘের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে নামে দুটি টিম। একটির তদন্ত করছেন বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তিন সদস্য। অপরটি স্থানীয়ভাবে জেলা বন বিভাগ, উপজেলা প্রশাসন ও প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর সমন্বিতভাবে তদন্ত করছে।
বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের তদন্ত কমিটির প্রধান বন্যপ্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিক বলেন, ‘আমরা স্থানীয় লোকজন, জনপ্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে তথ্য নিয়েছি। প্রাথমিক তদন্তে আমরা পেয়েছি– বাঘটিকে হত্যায় স্থানীয়রা জড়িত ছিল। হত্যা করা হয় শ্বাসরোধে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
স্থানীয়ভাবে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান আটোয়ারী উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘হত্যার কারণ হিসেবে পিটিয়ে, বিষ প্রয়োগসহ তিন ধরনের তথ্য এসেছে। ময়নাতদন্তে এ ধরনের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভিসেরা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এজন্য ঢাকায় ল্যাবে নমুনা পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন কত দিনের মধ্যে আসবে তা বলা যাচ্ছে না।’
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়– দ্বারখোর সীমান্ত এলাকার মানুষ বাঘটিকে লাঠিসোটা নিয়ে ধাওয়া করছেন। তখন বাঘটি ভয়ে নদের পানিতেই ছোটাছুটি করছে। মানুষজন নদীতে নেমে মাছ ধরার জাল দিয়ে বাঘটিকে তাড়া করতে থাকেন। তখন নদের তীরে একটি জঙ্গলে আশ্রয় নেয় বাঘটি। সেখানেও ধাওয়া দিলে আবার নদীতে নামে বাঘটি। একপর্যায়ে বাঘটি ক্লান্ত হয়ে স্থানীয়দের জালে ধরাশায়ী হয়। পরে বাঘটিকে ধরে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হত্যার পর বাঘটিকে একটি বাঁশে বেঁধে নেওয়া হয় বোধঁগাঁও বিজিবি ক্যাম্পে। সেখান থেকে বাঘটিকে নেওয়া হয় বারঘাটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে। সেখান থেকে বাঘটিকে ময়নাতদন্তের জন্য আটোয়ারী উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিসে নেওয়া হয়।
স্থানীয় কৃষক আব্দুল জব্বার বলেন, ‘চেঁচামেচি শুনে আমি কাছে যাই। দেখি বাঘটি বসে আছে। কাছে গেলেও বাঘটি নড়াচড়া করতে পারছিল না। আমরা তখন একটি জাল দিয়ে বাঘটিকে ঢেকে দেই। তখন বাঘটি নড়াচরা শুরু করলে একটি লাঠি দিয়ে ভালো করে জালে পেঁচিয়ে ধরি। তখন বাঘটি মনে হয় মারা গিয়ে নদীতে ডুবে যাচ্ছিল। পরে নদী থেকে ডাঙায় নিয়ে একটি বাশঁ দিয়ে বাঘের চার পা বেঁধে সামনে নিয়ে আসি।’
স্থানীয়দের দাবি– নয় দিন আগে এক কৃষকের গরু খেয়ে ফেলেছিল বাঘটি। পরে গরুটিতে বিষ ছিটিয়ে রাখা হয়। সেই গরুটি আবারো খেয়ে নদীতে পানি খেতে নামে বাঘটি। সেখানেই মরে পড়ে থাকতে দেখেন নাগর নদে মাছ ধরতে যাওয়া কয়েকজন। পরে বাঘটিতে উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় গৃহবধূ ময়না বেগম বলেন, ‘গত রবিবার আমার একটি গরু মারা যায়। গরুটিকে বাঘ নাকি শিয়াল আক্রমন করেছিল জানি না। তবে আমার ছোট ছেলে বলেছিল আমাদের এতবড় ক্ষতি করল, আমি তাকেও মেরে ফেলব। এরপর সে গরুর মধ্যে অল্প করে দানাদার বিষ দিয়েছে বলে শুনেছি। এখন বাঘটি বিষ খেয়ে মারা গেছে, নাকি ঠান্ডায় অসুস্থ বা অন্য কোনো কারণে মারা গেছে আমি জানি না।’
তোড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে আমার বাড়ি সাড়ে তিন কিলোমটিার দূরে। স্থানীয়দের কাছে শুনতে পাই– একটি বাঘ গরু খেয়েছে। পরে গরুতে বিষ দেওয়া হলে বাঘটি গরুটি খেয়ে মারা যায়। বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি আমি জানতাম না। ঢাকা থেকে একটা টিম এসেছে শুনেছি, আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি।’
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের বন্যপ্রাণী পরিদর্শক অসীম মল্লিক বলেন, ‘আমরা বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাঘের শরীর এবং উদ্ধারকাজে ব্যবহৃত জাল থেকে কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছি। বিষ টোপের কারণে না কি আঘাতে বাঘের মৃত্যু হয়েছে, সেটা পরে নিশ্চিত করে বলা যাবে। আমাদের তদন্তে উঠে আসা বিষয়গুলো নিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করব।’
বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী– কোনো ব্যক্তি চিতা বাঘ হত্যা করলে তিনি সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাইলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে শর্ত থাকে– চিতা বাঘ কোনো ব্যক্তিকে আক্রান্ত করলে এবং এতে তার জীবনশঙ্কার সৃষ্টি হলে জীবন রক্ষার্থে আক্রমণকারী চিতা বাঘ হত্যার ক্ষেত্রে এই ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে না। তবে আরও শর্ত থাকে– এ সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো মামলা দায়েরের প্রশ্ন দেখা দিলে, সংশ্লিষ্ট স্টেশন কর্মকর্তা ওয়ার্ডেনের সঙ্গে পরামর্শ করে মামলা দায়ের করতে পারবেন। বাঘের মৃত্যুর ঘটনায় শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বিকাল পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয়নি।
জানতে চাইলে পঞ্চগড় বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মধুসুধন বর্মন বলেন, ‘হত্যা হলেও সেটা পিটিয়ে না কি শ্বাসরোধে তা নিশ্চিত হয়। ঢাকা থেকে বন বিভাগের লোকজন এসে তদন্ত করছে। স্থানীয়ভাবেও তিন সদস্যর একটি তদন্ত দল তদন্ত করছে। মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যারা দোষী শনাক্ত হবেন আইন অনুযায়ী অবশ্যই তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’