মো: রেদওয়ানুল হক মিলন, পঞ্চগড় থেকে ফিরে:
প্রতিবছর পূজা শুরুর প্রাক্কালে চণ্ডীপাঠের
মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে আমন্ত্রণ জানাতে মহালয়ার দিন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের
বোদেশ্বরী মন্দিরে দুর্গার আবাহন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় বিশাল অনুষ্ঠান। এতে যোগ দিতে
কয়েক উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জড়ো হন আউলিয়ার ঘাটে। নতুন পোশাক আর রঙিন সাজ নিয়ে
দেড় শতাধিক মানুষ ওঠেন নৌকায়। কিন্তু মাঝনদীতে গিয়ে গভীর পানিতে তলিয়ে যায় নৌকাটি।
নৌকাডুবিতে ৭১ জনের প্রাণহানি হয় আর এখনো
নিখোঁজ রয়েছেন একজন। এ দুর্ঘটনায় শোকে স্তব্ধ করতোয়ারবাসী। ইতিহাসের ভয়াবহ এমন দুর্ঘটনার
সাক্ষী উত্তরের এই জনপদ। হঠাৎ শান্ত স্রোতের নদীটি হয়ে উঠবে বিষাদের কারণ তা কেউ জানতো
না। মুহূর্তেই স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে আউলিয়া ঘাটের বাতাস।
ভাসমান মরদেহ দেখে সেদিন স্তব্ধ হয়ে ছিলেন
নদী তীরের মানুষ। যেন মহালয়াতেই ম্নান পূজার সব আনন্দ। সেদিন যাদের আল্পনা আঁকার কথা
ছিল মণ্ডপের আঙিনায়,তারা চন্দনের ফোঁটা একেছে মৃত স্বজনের কপালে। আপনজনের শেষ যাত্রায়
অশ্রুর নীবর বহতা। যেখানে ঢাকের বাড়িতে নেচে উঠার কথা, সেখানে অবনত মস্তকে স্বজনের
মরদেহের সৎকারে ব্যস্ত ছিলেন পূজারিরা। সেদিন মণ্ডপগুলোতে ঢাকের বাড়ি, শাঁখের আওয়াজ
আর গৃহীনির উলুধ্বনির বদলে ছিল শোকস্তব্ধ স্বজনের গুঁমরে উঠা আর ফোঁপানো কান্নার শব্দ।
গত বছরের (২৫ সেপ্টেম্বর) বোদা উপজেলার
মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাটে দেড় শতাধিক যাত্রী নিয়ে এ নৌকাডুবির আজ এক বছর
তারই আদ্যোপ্রান্ত তুলে ধরা হলো:
প্রতিবছর মহালয়ার দিনে কমপক্ষে ২০ হাজারের
বেশি মানুষ আউলিয়া ঘাট থেকে নৌকায় করতোয়া পাড়ি দিয়ে বোদেশ্বরী মন্দিরে যান। ৩০ জন ধারণ
ক্ষমতার একটি নৌকা শতাধিক যাত্রী নিয়ে মহালয়ার অনুষ্ঠানের উদ্দেশে রওনা দেন। এ সময়
নৌকাটি কিছু দূর যাওয়ার পর দুলতে শুরু করলে মাঝি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। অতিরিক্ত
যাত্রীচাপে ডুবে যায় নৌকাটি। মুহূর্তেই উৎসব শোকে পরিণত হয়। অনেকেই সাঁতরে তীরে উঠলেও
শিশুসহ বাকিরা গভীর পানিতে তলিয়ে যায়।
এদিকে ডুবে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগে হ্যান্ডমাইকে
নৌকার মাঝিকে সাবধানও করেছিল পুলিশ। তবে, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সামনেই নৌকাটি
অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে ছাড়ার ঘটনায় প্রশাসনের গাফিলতি আছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে জেলা
প্রশাসন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলো। জেলা
প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে ইজারাদার আব্দুল
জব্বারের গাফিলতিসহ নৌকার মাঝি বাচ্চু মিয়া এবং রবিউল ইসলামকে দায়ী করা হয়। পরে পুলিশ
তাদের আটক করেন।
যারা বেঁচে ফিরল: নৌকাডুবির ঘটনায়
নির্বাক বেঁচে ফিরে আলো (২৫) ও অর্পিতা (১৭) দুই বোন। বাড়ির ৫ সদস্যকে হারিয়ে বারবার
মূর্ছা যাচ্ছেন তারা। কোনো সান্তনাই যেন তাদের বিলাপ থামাতে পারছে না। অন্যদিকে, মৃত্যুর
থেকে বেঁচে আসা বিনয় বলেন, আমি আমার বউসহ পরিবারের ৭ সদস্যকে নিয়ে সেদিন নৌকায় চড়ে
বোদেশ্বরীর মন্দিরে যাচ্ছিলাম হঠাৎ চোখের পলকে নৌকাটি ডুবে যায়। পরিবারের সবাই মারা
গেলেও আমি শুধু বেঁচে আছি।
রেলমন্ত্রী: নৌকাডুবির খবর
শুনে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন রেলমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি সেদিন স্থানীয়
প্রশাসনকে দোষারোপ করে বলেছিলেন, এ দুর্ঘটনায় প্রশাসনের গাফিলতি ছিল। এ ঘটনায় যেমন
ঘাটে দায়িত্বরতদের অবহেলা ও গাফিলতি রয়েছে, তেমনি
যাত্রীদেরও রয়েছে। এর ফলেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি
এটাই চিরন্তন সত্য।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বৃহস্পতিবার
(২৯ সেপ্টেম্বর) সকালে ঘটনাস্থলে ছুটে যান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী
এনামুর রহমান। নিহতদের প্রত্যেককে জেলা প্রশাসক এর পক্ষে ২০ হাজার, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান
ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার, ত্রাণ তহবিল থেকে ৫০ হাজার ও রেলমন্ত্রীর পক্ষে থেকে
৫ হাজার টাকা নিহত স্বজনদের হাতে তুলে দেন তিনি।
পঞ্চগড়ের মাড়িয়াগঞ্জ ও কালিয়াগঞ্জ দুটি
ইউনিয়নকে পৃথক করেছে করতোয়া নদী। এ অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই একটি সেতু নির্মাণের দাবি
জানিয়ে আসছিল স্থানীয়রা।
এত প্রাণহানির পরেও কি আউলিয়া ঘাটে ব্রিজ হবে না?: স্বাধীনতার ৫০ বছরেও পঞ্চগড়ের আউলিয়ার ঘাটে নির্মাণ হয়নি
একটি ব্রিজ। এর আগে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটলেও এবার নৌকাডুবিতে প্রাণ গেল ৭১ জনের। তবে
দ্রুত সময়ে ব্রিজ নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছেন পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য রেলমন্ত্রী অ্যাডভোকেট
নুরুল ইসলাম সুজন। করতোয়া নদী পারাপারের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেতে ইংরেজি বর্ণ ওয়াই
আকৃতির ব্রিজের কাজ দ্রুত শুরু হবে বলে সেদিন
বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদ মাঠে আয়োজিত শোকসভায় আশ্বাস দিয়েছিলেন মন্ত্রী। ব্রিজ নির্মাণের
প্রস্তাবনা একনেকে পাস হয়েছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এক বছর গত হয়ে গেলেও বাস্তবে
কোন কাজ শুরু হয়নি।
এত প্রাণহানির কারণ কী?: ৭১ জনের প্রাণহানির কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, ঘটনার দিন
হিন্দু সস্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রচুর মানুষ এসেছিলেন।
তাদের নিরাপত্তার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশ, দমকল বাহিনী, আনসার, গ্রাম
পুলিশ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের করতোয়া নদীর দুই পাড়ে মোতায়েন করা হয়েছিল।
মানুষের হুড়োাহুড়ি এবং অসচেতনতা: করতোয়া নদীতে ১২ মাস পানি থাকে এবং এই নদীর ওপর কোনো সেতু
নেই। ফলে নদী পারাপারের জন্য নৌকা এবং ট্রলারই ভরসা। নৌকা ডুবির ঘটনায় উদ্ধার অভিযানের
নেতৃত্ব দেয়া দমকল বাহিনীর কর্মকর্তা শাজাহান আলী বলেছেন, ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টা
থেকে তারা নদীর পাড়ে কাজ শুরু করেন। উৎসবের দিন হওয়ায় সেদিন ঘাটে প্রচুর মানুষের ভিড়
ছিল। এছাড়া নৌকা দিয়ে পার হতে আসা মানুষকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে, এমনকি হ্যান্ডমাইক
নিয়েও কিছুক্ষণ পরপর সতর্ক করা হলেও তা কেউ আমলে নেয়নি।
ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন: নদী পারাপারে প্রতিদিন সাধারণত কেবল একটি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত
ট্রলার চলে আউলিয়া ঘাট থেকে। কিন্তু মহালয়ায় হাজারো লোকের সমাগম হবে, তার প্রস্তুতি
হিসেবে তাদের পারাপারে ৬টি নৌকা দেয়ার আবেদন করা হয়েছিল সনাতন সস্প্রদায়ের পক্ষ থেকে।
কিন্তু সেদিন বরাদ্দ ছিল ৩টি নৌকা, যে নৌকাগুলো বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল, একেকটির দৈর্ঘ্য
১৮ থেকে ২০ ফুটের মতো। এই আকৃতির একটি নৌযানে সেদিন ১০০ বেশি মানুষ উঠে পড়েছিল, স্থানীয়দের
কেউ কেউ মনে করেন নৌকাতে দেড়শোর বেশি মানুষ ছিল।
ওই নৌকাডুবি থেকে বেঁচে ফিরেছেন এমন একজন
বলেছেন, ট্রলারে কোনো মানুষের বসার জায়গা ছিল না, তারা সবাই দাঁড়িয়ে ছিলেন।
নদীর গভীরতা কম, কিন্তু স্রোত ছিল বেশি: করতোয়া নদীতে ১২ মাস পানি থাকে ঠিকই, কিন্তু নদীটি খুব বেশি
গভীর নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলেছেন, ঘটনার আগের কয়েকদিন টানা বৃষ্টি
হয়েছিল, তার ফলে উজান থেকে পানি নেমে নদীতে পানির প্রবাহ অনেক বেড়েছিল।
ট্রলারে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি: দুর্ঘটনায় এত
প্রাণহানির আরেকটি কারণ হিসেবে স্থানীয়রা মনে করেন, ট্রলারে যাত্রীদের বড় অংশটি ছিলেন
নারী ও শিশু।
ঘটনার দিন সকাল থেকেই ওই নদীতে মাছ শিকার
করছিলেন গৌতম দাস। ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরার সময় হঠাৎ চিৎকারে পেছন ফিরতেই দেখেন নৌকাটি
ডুবে যাচ্ছে। নিমিষেই নৌকার যাত্রীরা নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। এ দৃশ্য যেন তিনি এখনো
ভুলতে পারছেন না। ডুবে যাওয়া নৌকাটিতে কয়েকজন পাথর উত্তোলনের শ্রমিক ছিলেন। তার মতে,
তারা খুব ভালো সাঁতার জানতেন। কিন্তু তার পরও কীভাবে এসব শ্রমিক পানিতে ডুবে মারা গেলেন
সেই হিসাব মেলাতে পারছেন না তিনি।