সুজন পাহান বয়স বাইশ বছর। বাবা বগা পাহান
জন্মের দুই বছর পর স্ত্রী-সন্তান রেখে চলে যায়। এরপর দু'বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে চলে
মা দুলালী পাহান এর অভাবের সংসার। বছর কয়েক পর তার বাবা মারা যায়। অন্যের বাড়িতে কাজ
করে ছেলের লেখাপড়া করান দুলালী পাহান। পঞ্চম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তার মা অসুস্থ্য
হয়ে পড়ে। এরপর মায়ের দেখা-শোনা ওষুধসহ সংসারের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে সুজন পাহানের
কাঁধে।
নিজে কর্ম করে খাওয়ার মতো কিছুই রেখে যাননি
তার বাবা। বসভিটাটুকুও অন্যের। কিন্তু মায়ের স্বপ্ন, অভাবের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়ে
উঠা একমাত্র মেধাবী ছেলে একদিন অনেক বড় চাকরি করবে। সুজনের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়ার
কশালগাঁও গ্রামে। আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায়ের পরিবারে তার বেড়ে ওঠা।
মায়ের স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে সুজন মাঠে কাজ
করার পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা অব্যাহত রেখেছেন। সুজনের সহপাঠীরা শিক্ষাজীবন থেকে অকালে
ঝরে পড়লেও সুজন কষ্ট করে নিজের শিক্ষা-জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুজন বর্তমানে রুহিয়া
ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রি ২য় বর্ষের পরিক্ষা দিয়ে ৩য় বর্ষে ভর্তির অপেক্ষায় রয়েছেন।
হাতে কাস্তি নিয়ে ফসলের মাঠে ধান কাটতে
কাটতে, কখনও আবার গৃহস্থালির কাজ করতে করতে, চলতে ফিরতে শিশুদের নিয়ে সব সময় ইংরেজিতে
কথা বলার চর্চা চালিয়ে রেখেছেন মুন্ডা জনগোষ্ঠীর অদম্য সুজন। প্রতিবেশীরা ভিনদেশি ভাষা
বুঝতে না পারায় অনেক সময় হাসি-ঠাট্টা করে তাকে পাগলও বলে। তবুও ইংরেজিতে কথা বলার চর্চা
থামাননি এই কৃষক যুবক। ছোট্ট এক একটি কুঁড়ে ঘর থেকে তিনি স্বপ্ন দেখেছে নিজের জীবনমান
উন্নয়ন করে কীভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের সামনে এগিয়ে নেয়া যায়। তাদের কাছে নিজেকে
অনুপ্রেরণা হিসেবে গড়ে তোলা যায়।
গতকাল কশালগাঁও গ্রামে গিয়ে কথা হয় সুজন
পাহানের সঙ্গে। তিনি বলেন, স্মার্ট ও টেকনোলজির যুগে ভালো কিছু করতে গেলে বাংলা ভাষার
পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজি শেখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আভাব অনটনের সংসারে
যেখানে পাঠ্যবই পড়ার সময় নেই সেখানে ভালো ইংরেজি শিখতে চাওয়াটা নিজের কাছেও কখনও কখনও
অপ্রাসঙ্গিক লেগেছে, তবে ইংরেজিতে কথা বলার প্রবল আগ্রহ ও ইচ্ছাশক্তির কাছে অসম্ভব
বলে কিছু নেই। আমি নিজের ভেতর সম্ভাবনা দেখছি। ফেসবুকে ইংরেজিতে কথা বলার ভিডিও দেখেই
ইংরেজি রপ্ত করার চেষ্টা করেছি এবং নিজের ইংরেজি চর্চার ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করছি।
কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজি কোর্স করার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি জীবনে।
তিনি বলেন, সারা দিন ইংরেজিতে কথা বলার
চেষ্টা করি। মানুষ হাসি-ঠাট্টা করে। অনেকেই ভাবে আমার বুঝি মাথার সমস্যা দেখা দিয়েছে,
কিন্তু আমি এসবের তোয়াক্কা করি না। মাঠের ফসলের সঙ্গে কাজের সময়, গৃহস্থালির কাজে ও
গবাদি পালনের সময় সবখানে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করি।
মাঠে কাজ করে যা আয় হয় তা নিত্যদিনের খরচ
আর জীবনযাপনে চলে যায় পাহানের। তার একটি ছোট চাকরি হলেও স্বপ্ন পূরণে একধাপ এগোতে পারতেন
বলে জানান পাহান।
কোথাও কোনো সহযোগিতা পেয়েছিলেন কি না জানতে
চাইলে তিনি বলেন, একটি বেসরকারি এনজিও সংস্থা ২০১৮ সালে দুই ধাপে ২৪ হাজার টাকা দিয়েছিল,
এ ছাড়াও উপজেলা পরিষদ থেকে আদিবাসী ছাত্র ছাত্রীদের শিক্ষাবৃত্তির অংশ হিসেবে ২০১৫
সালে ৪০০ টাকা ২০১৯ সালে শিক্ষা উপকরণ পেয়েছিলাম যা আমার লেখাপড়ার কাজে সহযোগী ভূমিকা
পালন করেছে। সেই থেকে আর কোনো সাহায্য পাইনি।
সুজনের সঙ্গে মাঠে কাজ করেন কৃষক বিনয়
পাহান। তিনি বলেন, আমি সুজনের সঙ্গে একই স্কুলে পড়তাম, অভাবের কারণে পড়াশোনা ছেড়েছি।
কিন্তু সুজন অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে পড়াশোনা করছে। ও অনেক মেধাবী।
সুজন সমাজে পিছিয়ে পড়া শিশুদের মাঝে বিলাতে
চান নিজের ভেতরে থাকা শিক্ষার আলো। তার আগে নিজেকে ভেঙে গড়ার সুযোগ দরকার সবার আগে।
কথা হয় সুজনের মা দুলালি পাহানের সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমার ছেলের ইচ্ছাশক্তি অনেক। কষ্টে তাকে বড় করেছি। যদি নিজে কাজ করতে পারতাম
তাহলে তাকে কখনও সংসার সামলাতে এত চাপ নিতে হতো না। ছেলেটার একটি চাকরি হলে খুব ভালো
হতো। নিজেকে মেলে ধরতে পারতো দেশের কল্যাণে।