আধুনিক যন্ত্রপাতির সংযোজন ও আধুনিকায়নের
ছোঁয়ায় এগিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। ফলাফল হিসেবে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ইতোমধ্যে
৩১ লাখ ৬৯ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বন্দরের সংক্ষমতা
আরও বাড়াতে সার্ভিস জেটি, ওভার ফ্লো ইয়ার্ড নির্মাণের পাশাপাশি নতুন টাগ বোট সংগ্রহ
করেছে বন্দর। ক্রীড়াঙ্গনে অবকাঠামোগত সংকট দূর করতে এবং প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন বাড়াতে
নিজস্ব অর্থায়নে আর্ন্তজাতিক মানের সুইমিং কমপ্লেক্স তৈরি করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেই
সঙ্গে শুধু চট্টগ্রাম নয়, পুরো দেশকে এর মধ্য দিয়ে সক্ষমতার বার্তা জানিয়ে দিচ্ছে সরকারের
গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটি।
বহুল প্রতিক্ষীত এ চার প্রকল্পের উদ্বোধনের
অপেক্ষায় ছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। অবশেষে আজ রোববার সকাল বারিক বিল্ডিং মোড় এলাকায় ফলক
উন্মোচনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের সার্ভিস জেটি উদ্বোধন করেছেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম
শাহজাহান, সদস্য মো. জাফর আলম, সচিব মো. ওমর ফারুকসহ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বন্দরের
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে ছিল— বন্দরের জন্য
ওয়েস্টার্ন মেরিন থেকে কেনা টাগবোট কাণ্ডারী ৬ হস্তান্তর, ওভার ফ্লো ইয়ার্ড ও সুইমিং
কমপ্লেক্স উদ্বোধন।
নবসংগৃহীত টাগবোট হস্তান্তর ও নবনির্মিত
সার্ভিস জেটি উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ
চৌধুরী বলেন, বন্দরে গতিশীলতা বেড়েছে, এটা আমাদের জন্য সুখবর। প্রধানমন্ত্রী গত ১২
বছর ধারাবাহিকভাবে দেশ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে শুধু চট্টগ্রাম বন্দর নয়, পুরো দেশ
এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের
অর্থনৈতিক ধারা বজায় আছে। পৃথিবীর অনেক দেশ নেতৃত্বের কারণে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মুখ
থুবড়ে পড়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব না থাকলে আমরা এ স্বাধীন দেশ পেতাম না।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতির মূল গেটওয়ে
চট্টগ্রাম বন্দর। করোনার মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন ১২টি করে জাহাজ খালাস করা
হয়েছে। চট্টগ্রামের যেখানে সামাজিক দুর্বলতা আছে চট্টগ্রাম বন্দর সেখানে হাত বাড়িয়ে
দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়। এখন থেকে আরও বেশি উদ্যমী হয়ে কাজ করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের
শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি আন্তরিক। এটা আমার খুব ভাল লাগে, আমাকে প্রেরণা জোগায়। এই চট্টগ্রাম
বন্দরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগ করতে চায়। দেশ যত এগিয়ে যাবে, ততো বেশি ষড়যন্ত্র
তৈরি হবে। তাই আমাদেরকে ষড়যন্ত্র রুখে দিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। সামনে চট্টগ্রাম
বন্দরের অনেক কাজ। বেটারমিনাল, মাতারবাড়িসহ অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আছে। সেটা নিয়ে কাজ
করতে হবে।
সুইমিংপুল উদ্বোধনকালে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের
প্রতিমন্ত্রী বলেন, চট্টগ্রাম সবক্ষেত্রে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী
একজন ক্রীড়াবান্ধব মানুষ। আমরা আশা করি আমাদের নতুন প্রজন্মরা নিজেদের সুনাগরিক হিসেবে
গড়ে তুলবে। দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, আজ চট্টগ্রাম বন্দরে
একটি আন্তর্জাতিক মানের সুইমিংপুল,টেনিস কোড ও বাস্কেট বল উদ্বোধন করা হয়েছে। এরমধ্য
দিয়ে বিভিন্ন খেলাধুলার সুযোগ তৈরি হবে। ১ দশমিক ৩ একর জায়গার উপর ৮ লেইন বিশিষ্ট সুইমিংপুলটি
তৈরি করা হয়েছে। এখানে সবাই সাঁতার শিখতে পারবে। পাশাপাশি একটি সুপরিসর গ্যালারীও রয়েছে
এখানে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর
ফারুক বলেন, ‘দিন দিন বন্দর সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। বন্দর কর্মকর্তা,
কর্মচারি ও ব্যবহারকারীদের আন্তরিক চেষ্টা ও সহযোগিতায় বন্দর এগিয়ে যাচ্ছে, সামনে আরও
এগিয়ে যাবে। বন্দরে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন হয়েছে। এতে করে বন্দরের সক্ষমতা আরো
বাড়বে। জাহাজের সুরক্ষা বাড়বে, কনটেইনার জটের ঝামেলাও কমে যাবে। নতুন বছরে নতুন টাগ
বোট, সার্ভিস জেটি, ওভার ফ্লো ইয়ার্ড সংযোজন হওয়া এটি বন্দরের পক্ষ থেকে নগরবাসীর জন্য
এক ধরনের চমকপ্রদ উপহার।’
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, সার্ভিস
জেটির সমস্যা সমাধানে ৮৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২২ ফুট লম্বা সার্ভিস জেটি নির্মাণ করা হয়েছে।
এর ফলে এখন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের মালিকানাধীন বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৩৫টি ভেসেল পরিচালনা
করা হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বন্দরে জাহাজের সুরক্ষা ও অপারেশনাল কার্যক্রমে গতি
আসবে। এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে দুই হাজার ৬৫০ বর্গফুটের তিনতলা একটি অফিস ভবন, ৩ হাজার
বর্গফুটের স্টিল কাঠামোর একটি ওয়্যারহাউস, ২ হাজার ১০০ কিউবিক মিটারের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড
পানির রিজার্ভার, ২২২ মিটার লম্বা ৮ ফুট উঁচু রিটেইনিং ওয়াল, রিভার ব্যাংক ও শোর প্রোটেকশন,
ড্রেনেজ সিস্টেম, ৫০০ কেভির বৈদ্যুতিক সাব স্টেশন, ১০০ ফুট উঁচু সিগন্যাল টাওয়ার নির্মাণ
করা হয়েছে।
প্রায় ৩৭ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ৪০টি বিপি
(বলর্ড পুল-জাহাজের শক্তির একক) ক্ষমতার একটি টাগবোট সংযোজন হয়েছে বন্দরের বহরে। সবমিলিয়ে
চট্টগ্রাম বন্দরে এখন আটটি টাগ বোট রয়েছে। এর গভীরতা ৩ দশমিক ৭৫ মিটার এবং লম্বায় ৩৩
মিটার। ২০১৭ সালে টাগবোটটি বানানোর জন্য ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপ ইয়ার্ডের চুক্তি করে
চট্টগ্রাম বন্দর। ২০১৯ সালের ৩০ জুন এই প্রকল্পের পুরোপুরি কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও
করোনাভাইরাসের কারণে সব ভেস্তে যায়। ফলে এই প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে যায়। তবে আগামী ২
জানুয়ারি টাগ বোটটি ওয়েস্টার্ন মেরিন কর্তৃপক্ষ বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিক
হস্তান্তর করবে। পাশাপাশি নগরের ফ্রিপোর্ট মোড় পুরাতন লেবার কলোনির জায়গায় ‘নিউমুরিং ওভারফ্লো
কনটেইনার ইয়ার্ড’ নির্মাণ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এই ইয়ার্ডে
প্রায় ১২ হাজার কনটেইনার রাখা যাবে। ফলে বন্দরের প্রয়োজনে ও বিভিন্ন সময়ে কনটেইনার
চাপ বেড়ে গেলেও জট তৈরির সম্ভাবনা অনেকাংশেই কমে যাবে বলে মনে করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে বন্দর স্টেডিয়ামের পাশে অত্যাধুনিক
সুযোগ সুবিধা সম্বলিত আরেকটি আর্ন্তজাতিক মানের সুইমিং কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে।
এর পুরো ব্যয়ভার বহন করেছে ব্ন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সোয়া একর জায়গার
উপর নির্মাণ করা হয়েছে সুইমিং কমপ্লেক্সটি। এখানে আলাদা দুইটি সুইমিং পুল রয়েছে। আর্ন্তজাতিক
মানের তৈরি ১২৫০ বর্গমিটার (দৈর্ঘ্যে ৫০ মিটার ও প্রস্তে ২৫ মিটার) আয়তনের প্রধান পুলে
রয়েছে ৮টি লেন। যার একপাশের গভীরতা সাড়ে চার ফুট এবং অপরপ্রান্তের গভীরতা সাড়ে তের
ফুট। যাতে একসাথে ৮ জন সাঁতারু লো ডাইভিং দিতে পারবেন। এছাড়া কমপ্লেক্সের প্রধান পুলের
পাশে ৫০ ফুট দৈর্ঘ্য লম্বা ও ২০ ফুট প্রস্তের আরো একটি ক্ষুদে সুইমিং পুল। যাতে ক্ষুদে
ও শিক্ষানবীশরা সাঁতার শিখতে পারবেন। যার একদিকের গভীরতা দুই ফুট ও অপরপ্রান্তে ৪ ফুট।
এছাড়া পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের জন্য আলাদা আলাদভাবে ড্রেসিংরুম, শাওয়ার জোন ও টয়লেটের
ব্যবস্থা। সুইমিং কমপ্লেক্সটি চালু হলে পেশাদার সাঁতারুরা যেমন প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন
করতে পারবেন। তেমনি দক্ষ ট্রেনারে মাধ্যমে সাঁতারও শিখতে পারবেন নতুনরা।