লীলা রায়। বিপ্লবী অগ্নিকন্যা তিনি। বাংলার
অনগ্রসর, অন্ধকারে নিমজ্জিত নারী সমাজের অগ্রদূত। এই মহীয়সী নারী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রথম ছাত্রী। তার হাত ধরেই ঢাবিতে নারী শিক্ষার সূচনা হয়। একাধারে তিনি ছিলেন একজন
সাংবাদিক, জনহিতৈষী ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে
বিপ্লবী অগ্নিকন্যা, বাংলার নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ তিনি।
লীলা রায় উপমহাদেশ বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। উপমহাদেশে বিখ্যাত আরেক বিপ্লবী
অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা এই লীলা রায়ের কাছেই বিপ্লবী চেতনার দীক্ষা লাভ করেন।
১৯০০ সালের ২ অক্টোবর পিতার কর্মস্থল আসামের
গোয়ালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করলেও এই মহীয়সী নারীর পৈত্রিক নিবাস ছিল বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার
জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁও গ্রামে। তারা পরিবার ছিল বৃহত্তর সিলেটের খুব পরিচিত
সংস্কৃতিমনা ও উচ্চশিক্ষিত। বাবা গিরীশচন্দ্র নাগ আসাম সরকারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট
হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার মা কুঞ্জলতা নাগ ছিলেন গৃহিনী। তবে স্বাদেশিকতার আন্দোলনে
দীক্ষিত ছিলেন তিনি। আর এ কারণেই মায়ের প্রভাবে লীলা রায় ত্যাগ ও সংগ্রামের আদর্শকে
জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন।
১৯১১ সালে লীলা রায় ভর্তি হন ঢাকার ইডেন
হাইস্কুলে। ১৯১৬ সালে পিতা গিরীশচন্দ্র নাগ চাকরি হতে অবসর গ্রহণের পর স্থায়ীভাবে সপরিবারে
বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৯১৭ সালে ইডেন হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে
উত্তীর্ণ হন লীলা রায়। তবে ১৯১৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর তিনি উচ্চশিক্ষা
গ্রহণের জন্য কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন।
পড়াশোনায় তার গভীর আগ্রহ ছিল। একই বছর
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে এম এ করার জন্য ভর্তি হন। তখনো ঢাবিতে সহশিক্ষার
প্রচলন ছিল না। তার জেদ, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়বেন। মেয়েরা কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়তে পারবে না এই মর্মে লীলা রায় ঢাবির চ্যান্সেলর (বাংলার গভর্নর) ও ভাইস চ্যান্সেলরের
সাথে দেখা করে নিজের বিষয়টি জানান।
তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর পি জে হার্টজ
লীলার মেধা ও আকাঙ্ক্ষার কথা বিবেচনা করে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিশেষ অনুমতি প্রদান
করেন। ঢাবিতে তার ভর্তি ক্রমিক নাম্বার ছিল ২৫। এভাবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার
অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হওয়ার গৌরব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাবস্থাতেই
লীলা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ও ঋষি রামানন্দের সাহচর্য
লাভ করেন। ১৯২৩ সালে তিনি ইংরেজিতে ২য় বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনিই ছিলেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রিধারী। শিক্ষাজীবন শেষ করে লীলা নারীশিক্ষার প্রসার
ও স্বদেশের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে ব্রতী হন। নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্ত
করার জন্য ১২ জন সংগ্রামী সাথী নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘দীপালি সংঘ’। এই সংঘের মাধ্যমে
তিনি দীপালি স্কুল ও আরো ১২টি অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
নারীশিক্ষা মন্দির ও শিক্ষাভবন নামেও দুটি
স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকায় তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল দীপালি-১ পরবর্তীতে নাম বদলে হয়
কামরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুল, আর নারীশিক্ষা মন্দির নাম হয় শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়।
এছাড়াও ঢাকার আরমানিটোলা বালিকা বিদ্যালয়ের
প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন তিনি। বিয়ের পর লীলা কলকাতায় চলে যান এবং সেখানেও বেশ কিছু শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এছাড়াও তিনি দীপালি ছাত্রী সংঘ ও মহিলা আত্মরক্ষা কেন্দ্রও গড়ে
তোলেন। বিপ্লবী পুলিন দাসের নেতৃত্বে মেয়েরা সেখানে অস্ত্র চালনা ও লাঠিখেলা শিখতেন।
লীলা নাগ ঢাকা কলেজে পড়তেন। তার এক ক্লাস
উপরের ছাত্র ছিলেন সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন। লীলা নাগ সম্পর্কে তিনি তার স্মৃতিকথা
নামক প্রবন্ধ সংকলনে লেখেন, ‘তাঁর মত সমাজ-সেবিকা ও মর্যাদাময়ী
নারী আর দেখি নাই। তাঁর থিওরী হল, নারীদেরও উপার্জনশীলা হতে হবে, নইলে কখনো তারা পুরুষের
কাছে মর্যাদা পাবে না। তাই তিনি মেয়েদের রুমাল, টেবলক্লথ প্রভৃতির উপর সুন্দর নক্সা
এঁকে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সব বিক্রি করে তিনি মেয়েদের একটা উপার্জনের
পন্থা উন্মুক্ত করে দেন।’
দীপালি সংঘ তৈরির আগে থেকেই লীলা বিপ্লবীদের
সাথে জড়িয়ে গিয়ে ছিলেন। নেতাজীর অনুরোধে তার প্রকাশিত ইংরেজি সাপ্তাহিক ফরওয়ার্ড ব্লকের
সম্পাদনার ভার নেন লীলা। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে দীপালি সংঘের বৈপ্লবিক পরিবর্তন
হতে থাকে। দলে দলে মেয়েরা এর পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। আসাম ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে
এর শাখা বিস্তৃত হতে থাকে।
নারী সমাজের মুখপাত্র হিসেবে ‘জয়শ্রী’ নামে একটি পত্রিকাও
বের করেন তিনি। ছাত্রীদের সুবিধার জন্যে কলকাতায় একটি মহিলা হোস্টেল তৈরি করান তিনি।
বিপ্লবী নেত্রী লীলা রায়ের কাছে দলের ছেলেরাও আসতেন নানা আলোচনার উন্মুখতা নিয়ে। প্রীতিলতার
মতো সুপরিচিত নারী বিপ্লবীরাও এই দীপালি সংঘের মাধ্যমেই বিপ্লবের পাঠ নিয়েছিলেন লীলা
রায়ের কাছ থেকে।
দীপালি সংঘ ছাড়াও বিপ্লবী অনিল রায়ের শ্রীসংঘের
সাথেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৩০ সালে সব বিপ্লবী দলের নেতাদের ইংরেজ সরকার একযোগে গ্রেফতার
করা শুরু করলে অনিল রায়ও গ্রেফতার হন। ফলে শ্রীসংঘের দায়িত্ব পুরোটাই এসে পড়ে লীলার
উপর। শ্রীসংঘের সদস্যরা সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও বোমা তৈরির
কাজ করতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র
অনিল দাস ও শৈলেশ রায় বোমার ফর্মুলা নিয়ে কাজ করতেন। ১৯৩১ সালে বিপ্লবীদের কার্যকলাপ
আরো জোরদার হয়। পরপর বেশ কিছু জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা জজ বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন।
এর মধ্যে কুমিল্লার জেলা জজ স্টিভেন্সের হত্যার সাথে দু’জন তরুণী জড়িত
থাকার সন্দেহে পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠে।
১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর দীপালি সংঘের কাজ
সেরে বাড়ি ফেরার পথে লীলা নাগকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৭
সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত লীলা ঢাকা, রাজশাহী, সিউড়ী, মেদিনীপুর জেল ও হিজলী বন্দিশালায়
আটক ছিলেন। ভারতবর্ষে বিনা বিচারে আটক হওয়া প্রথম নারী রাজবন্দী লীলা রায়। পরবর্তীতে
আরো অনেকবার কারাভোগ করতে হয় তাকে।
জেল থেকেই লীলা সাংগঠনিক সংহতিকে অ্যাকশন
ওরিয়েন্টেড করে বৈপ্লবিক সংঘাত পরিচালনার প্রয়াস চালান। ১৯৫১ সালে ভারত সরকার প্রণীত
উদ্বাস্তু উচ্ছেদের বিলের বিরোধিতা করে আবারও গ্রেফতার হন লীলা।
১৯৫২ সালে লীলা নাগের স্বামী অনিল রায়
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিয়ের মাত্র ১৩ বছরের মাথায় অকাল বৈধব্য ও বহুদিনের
আন্দোলন- সংগ্রামের সাথীকে হারিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন লীলা। তবে
কম সময়ের মধ্যেই শোক কাটিয়ে স্বদেশের বৃহত্তর স্বার্থে পুনরায় মনোনিবেশ করেন তিনি।
১৯৫২ সালের খাদ্য আন্দোলনেও তিনি সক্রিয়
ছিলেন।
১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাকে কলকাতার পি.পি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৩ দিন পর সংজ্ঞা ফিরে এলেও বন্ধ হয়ে যায় তার বাকশক্তি। শরীরের ডান অংশ সম্পূর্ণরূপে অচল হয়ে যায়। এভাবেই আড়াই বছর চলার পর ১৯৭০ সালের ১১ জুন না ফেরার দেশে চলে যান ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এই মহানায়িকা।