ঢাকা শহরের
প্রায় ১৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা, শিক্ষার্থীসহ ছয় হাজার নারী জরায়ু ক্যানসারের
ভ্যাকসিন নেওয়ার পর জানা গেল সেটা ছিল নকল। একটি প্রতারক চক্র এই ভ্যাকসিন দিয়ে কয়েক
কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
নকল এই ভ্যাকসিন
নিয়ে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। একজন তো ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর বাড়ি ফিরেছেন।
যারা এই ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তাদের একজন রাজধানীর আজিমপুরের গভর্ণমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড
হিউমেন সায়েন্সের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাসা মানিকদী। সেখানে মাইকিং করা হচ্ছিল, যারা জরায়ু ক্যানসারের
ভ্যাকসিন নেননি তাদের স্বল্পমূল্যে দেওয়া হবে। পাশাপাশি হেপাটাইটিস বি এর ভ্যাকসিনও
দিচ্ছে। এই শুনে আমি ও আমার ছোট বোন মানিকদী সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে
জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিন নেই। আমার খালা নিয়েছেন হেপাটাইটিস বি এর ভ্যাকসিন। প্রথম
ডোজ নেওয়ার পর আমাদের তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর জ্বর এসেছিল।
জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিনের জন্য আমাদের কাছ থেকে আড়াই হাজার টাকা করে নিয়েছে। আর
হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিনের জন্য খালার কাছ থেকে নিয়েছে ৩০০ টাকা। তারা আসলে মিরপুর দারুস
সালামের ডা. এ আর খান ফাউন্ডেশন, দক্ষিণখানের আল নূর ফাউন্ডেশন ও চেরাগ আলীর পপুলার
ভ্যাকসিনেশন সেন্টারের কথা বলছিল। যে কারণে আমাদের সন্দেহ হয়নি।’
কীভাবে এই চক্রের
সন্ধান পেলেন জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের (ডিবি) উপকমিশনার গোলাম
সবুর বলেন, ‘ঢাকার একটি জায়গায় ভ্যাকসিন দিতে আসা লোকদের আটকে রেখেছে নারীরা। ওই
ভ্যাকসিন নিয়ে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এমন খবর পেয়ে আমরা সেখানে যাই। প্রাথমিকভাবে
তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে আমরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করি। পরে
জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করে এতদিন ধরে নকল ভ্যাকসিন দিয়েছে। তখন আমরা অনুসন্ধান
শুরু করি। সর্বশেষ গত সোমবার এই চক্রের হোতা হিমেলকে আমরা গ্রেপ্তার করি। ঢাকার দক্ষিণখানে
ও কেরানীগঞ্জে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এই ভ্যাকসিন বানানো হচ্ছিল। আমরা খুব শিগগিরই
পুরো চক্রকে ধরে ফেলব।’
নকল ভ্যাকসিন
তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করার পর জিজ্ঞাসাবাদে তারা
ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়টি জানিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা হলেন—সাইফুল ইসলাম শিপন, ফয়সাল আহম্মেদ,
আল আমিন, নুরুজ্জামান সাগর ও আতিকুল ইসলাম। তাদের প্রত্যেককে দুইদিন করে রিমান্ড শেষে
কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
তিন বছর ধরে
বাংলাদেশে জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিন সেরাভিক্স আমদানি বন্ধ রয়েছে। আর এটাকে সুযোগ
হিসিবে কাজে লাগায় প্রতারক চক্রটি। হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিনের একটি অ্যাম্পুল খুলে অন্তত
১০টি জরায়ু ক্যানসারের নকল ভ্যাকসিন বানিয়ে বিক্রি করছে চক্রটি। তাদের চোরাইপথে ভারত
থেকে এই ভ্যাকসিন আনতে অ্যাম্পুল প্রতি খরচ হয় ৩৫০ টাকা। একটি অ্যাম্পুল খুলে ১০টি
অ্যাম্পুল বানানো হয়। পরে সেগুলোতে লাগিয়ে দেওয়া হয় জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিন সেরাভিক্সের
লেবেল। লেবেল লাগানোর পর জরায়ু ক্যানসারের ভ্যাকসিন সেরাভিক্সের প্রতিটি অ্যাম্পুল
বিক্রি করা হয় আড়াই হাজার টাকা করে।
পুলিশ কর্মকর্তা
গোলাম সবুর বলেন, ‘প্রায় ছয় হাজার নারীর কাছে জনপ্রতি তিনটি করে ১৮ হাজার অ্যাম্পুল ভ্যাকসিন
বিক্রি করে চক্রের সদস্যরা। এর মাধ্যমে তারা হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা।
গ্রেপ্তারকৃতরা স্বীকার করেছে, ঢাকা ও আশপাশের প্রায় ১৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভ্যাকসিনেশন
ক্যাম্প করে নকল টিকা দেওয়া হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রী, শিক্ষিকা ও অভিভাবকদের
কাছে নকল ভ্যাকসিনের তিনটি করে ডোজ বিক্রি করেছে।’
কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
এই ধরনের ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম চালালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে অনুমতি
নিতে হয়। সংস্থাটির ঢাকা বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠানও আমাদের কাছ থেকে
কোনো অনুমতি নেয়নি। ফলে আমরা এসবের কিছুই জানি না।’
শিক্ষার্থীসহ
প্রায় ছয় হাজার নারীকে জরায়ু ক্যানসারের নকল ভ্যাকসিন দেওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশের
পর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের চিঠি দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন
অধিদপ্তর। চিঠিতে ঔষধ প্রশাসন বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পূর্বানুমতি ছাড়া এ ধরনের ভ্যাকসিনেশন
প্রোগ্রাম স্কুল-কলেজে না চালাতে অনুরোধ করা হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমতি
ছাড়া স্কুল-কলেজে ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম আয়োজন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
ঔষধ প্রশাসন
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ স্বাক্ষরিত চিঠির অনুলিপি দেওয়া
হয়েছে সব জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সব জেলার ঔষধ প্রশাসনকে।
এতে বলা হয়, সেরাভিক্স ভ্যাকসিন নকল পাওয়া গেছে। আন-রেজিস্টার্ড হেপাটাইটিস-বি এর ভ্যাকসিনের
ভায়াল থেকে খালি ভায়ালে আংশিক ভরে সেরাভিক্স ভ্যাকসিনের লেবেল লাগিয়ে একটি চক্র নকল
করছে। গত ১৮ মার্চ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর দারুস সালামের ডা. এ আর খান ফাউন্ডেশন থেকে
নকল ভ্যাকসিনের আলামত পেয়েছে। গাজীপুর জেলার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে নকল ভ্যাকসিনের প্রচারণা
করা হয়েছে।
চিঠিতে বিশেষ
অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়েছে, স্কুল-কলেজ ও বেসরকারি পর্যায়ে কোনো ধরনের ভ্যাকসিনেশন করতে
হলে এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পূর্বানুমোদন থাকা আবশ্যক।
পূর্বানুমতি ছাড়া এ ধরনের ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম স্কুল-কলেজে না করার জন্য বিশেষভাবে
অনুরোধ করা হলো।