দখল আর দূষণে মরতে বসেছে জেলা শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী বামনডাঙ্গা নদী। একসময়ের প্রমত্তা এই নদী এখন পরিণত হয়েছে নালায়। সরকারি বরাদ্দ থাকার পরও প্রভাবশালী মহলের চাপে বন্ধ হয়ে গেছে খননকাজ। কিন্তু এসব বাধার কাছি যেন অসহায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
তবে অভিযুক্ত অবৈধ দখলদারদের দাবি, তারা রেকর্ড ও পৈতৃক সূত্রে নদীর জমির মালিক। বরং তারা পৌর মেয়রের অনুরোধে শহরের পানিনিষ্কাশনের জন্য কিছুটা জায়গা ছেড়েছেন। কিন্তু জীবনের জন্য নদীর যে অবদান, সে গুরুত্ব অনুধাবন করে ঐতিহ্যবাহী এই নদী উদ্ধারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে, প্রায় শত বছর আগে বামনডাঙ্গা নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল শাখামাছা বন্দর, আর এই শাখামাছা বন্দরই আজকের নীলফামারী শহর। সে সময়ে এই নদীতে ভিড়ত পণ্যবাহী নৌকা। কথিত আছে, এই নদীতে নোঙর করেছিল বেহুলা আর দেবী চৌধুরানীর নৌবহর। যুগে যুগে প্রভাবশালীদের দখল আর দূষণে হারিয়ে গেছে একসময়ের খরস্রোতা বামনডাঙ্গা নদী। যা আজ পরিণত হয়েছে আবর্জনার স্তূপে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীর বিভিন্ন স্থান দখল করে মাটি ভরাট করে স্থাপনা করায় বন্ধ হয়ে গেছে পানিপ্রবাহ। উৎপত্তিস্থল থেকে শেষ মাথার বিভিন্ন অংশ অনেকটা দখলদারের কবলে। অন্যদিকে নদীর আশপাশের বাসিন্দারা ময়লা-আবর্জনা ফেলে প্রায় ভরাট করে ফেলেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই এটি নদী।
নীলফামারী পৌর শহরের মানিকের মোড় এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, এই নদী আগে অনেক বড় ছিল। এই নদীতে পণ্যবাহী নৌকা চলত। দীর্ঘদিন নদীটি খনন না হওয়ায় পলিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীর জমি গ্রাস করে বাসাবাড়ি, অটো রাইস মিল, কনস্ট্রাকশন ফার্মসহ নানা স্থাপনা তৈরি করছে প্রভাবশালীরা।
বামনডাঙ্গা নদীর তীরে শৈশব কেটেছে স্কুল শিক্ষক মনিরুল ইসলামের। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ৩০ বছর আগেও এই নদী প্রায় ১০০ ফুট চওড়া ছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক দখলের কারণে এখন বামনডাঙ্গা নদীকে নালা বললেও ভুল হবে। বর্তমানে এই নদী খালে পরিণত হয়েছে। নদীপারের বাসিন্দা সফিকুল ইসলাম বলেন, দুই পারের পরিবারগুলো নদীতে বর্জ্য ফেলে নদীর পানি দূষিত করছে। এতে বাতাসে রোগজীবাণু ছড়াচ্ছে। লোকজন আক্রান্ত হচ্ছে রোগব্যাধিতে। এ ছাড়া হারিয়ে গেছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। নীলফামারী পৌর শহরের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম বলেন, নীলফামারী শহরকে বাঁচাতে হলে বামনডাঙ্গা নদী খননের উদ্যোগ নিতে হবে। দখল উচ্ছেদ করতে হবে বামনডাঙ্গা নদীকে তার আগের রূপে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) কলা অনুষদে ডিন ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ঐতিহ্যবাহী বামনডাঙ্গা নদী দখল হয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেকর্ড হয়ে গেছে। এখন নিয়ম অনুযায়ী নদীতে থাকা ব্যক্তিমালিকানা জমির রেকর্ড বাতিল করে এর প্রবাহ সচল রাখতে হবে। একই সঙ্গে এই নদীকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে খনন করতে হবে। পাশাপাশি সীমানা নির্ধারণ করা জরুরি।
পাউবো নীলফামারী বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কৃষ্ণকমল চন্দ্র সরকার বলেন, বামনডাঙ্গা নদী নিয়ে জেলা পানিসম্পদ কমিটির সভায় জোরালো আলোচনা হয়েছে। এই নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে রেকর্ড সংশোধনের মামলা করা হবে। কার্যক্রমগুলো চলমান আছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারের ডেল্টা প্ল্যানের আওতায় প্রায় সাত কিলোমিটার খননকাজ শুরু করলেও নানা বাধার সম্মুখীন হয়ে তা শেষ করতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড।