পাঁচ সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ৪১ জন নেতাকর্মী দলীয় ফরম সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে সর্বাধিক ১৭ জন আগ্রহী ছিলেন। এ সিটিতে সেখানকার সাময়িক বরখাস্ত মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে বাদ দিয়ে দলের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খানকে। তাকে মনোনয়ন দেওয়ায় আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী জাহাঙ্গীর আলম বিদ্রোহী প্রার্থী হন কি না, তা নিয়ে এখন চলছে জল্পনা-কল্পনা।
আর গত শনিবার আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে প্রার্থীদের নাম ঘোষণার পর জাহাঙ্গীর আলম নিজেও বলেছেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেলেও জনগণ যদি চায় তাহলে তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি ভোটের লড়াইয়ে থাকবেন। এমন পরিস্থিতিতে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেই পুরনো ‘জাহাঙ্গীর খেলা’ শুরুর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও গাজীপুরের স্থানীয় কিছু নেতা মিলে এই ‘খেলা’র মাধ্যমে নিজেদের শক্তির জানান দিতে চান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ও জাহাঙ্গীরের শত্রু-মিত্ররা সবাই একাট্টা হয়ে ‘জাহাঙ্গীর খেলা’ শুরুর ছক সাজাচ্ছেন। আর এ খেলার সুফল-কুফল নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। এরই মধ্যে ঢাকায় আওয়ামী লীগ তিন প্রভাবশালী নেতার বাসায় জাহাঙ্গীর একাধিকবার ঢু মেরে আলোচনা সেরে গেছেন। গতকাল সোমবার পুরো দিনই তিনি ঢাকায় অবস্থান করেন। কেন্দ্রীয় বিভিন্ন নেতার সঙ্গে দেখা করে নিশ্চিত হতে চেয়েছেন যে নির্বাচনে প্রার্থী হলে হামলা-মামলা বা অন্য কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি তাকে হতে হবে কি না? আর প্রার্থী হলে দল ও সরকার থেকে ঝামেলার মুখে পড়তে হবে না এমন নিশ্চয়তা পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মাঠে লড়াই করবেন। নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী প্রার্থিতা ঘোষণার জন্য হাতে সময় থাকায় আরও কয়েক দিন এসব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ভেবেচিন্তে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল রাতে জাহাঙ্গীর আলমের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে এই প্রতিবেদক তার পরিচয় উল্লেখ করে কল করার কারণ জানিয়ে বার্তা পাঠালেও সাড়া পাওয়া যায়নি তার।
জাহাঙ্গীর আলমের ঘনিষ্ঠ এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘তিনি (জাহাঙ্গীর) দলীয় পদের চেয়ে মেয়র পদের জন্য যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে রাজি আছেন। তার আত্মবিশ্বাস, প্রচারণায় বের না হয়েও মেয়র নির্বাচিত হবেন। হামলা-মামলার শিকার না হয়ে শুধু দল থেকে বহিষ্কারের মতো পদক্ষেপ নিলেও ভোটের মাঠে থাকবেন জাহাঙ্গীর।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কেন্দ্রীয় এক নেতার নেতৃত্বে আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীরকে নিজের শক্তির ওপর ভর করে নির্বাচনে প্রার্থী হতে উৎসাহিত করে তুলেছেন বলে জানা গেছে। জাহাঙ্গীরের শক্তির উৎস যে কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন তারা তাকে বলেছেন, শক্তির জায়গায় আত্মবিশ্বাসী থাকলে নির্বাচনে নেমে পড়তে। কারণ বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেবে না। ফলে জাহাঙ্গীরের বিজয়ী হয়ে আসার সুযোগ আছে।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ২৭ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ৩০ এপ্রিল। এরপর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ৮ মে। প্রতীক বরাদ্দ হবে ৯ মে। ভোটগ্রহণ হবে ২৫ মে। তাই প্রার্থিতার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে জাহাঙ্গীর আলম আরেকটু সময় নিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র জানায়, শীর্ষ পর্যায়ের এক কেন্দ্রীয় নেতাসহ অন্তত ছয়জন প্রভাবশালী নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে দলের মনোনয়ন পাইয়ে দিতে জোর চেষ্টা চালান। কিন্তু আজমতের রাজনৈতিক ত্যাগের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সিটিতে মেয়র প্রার্থী বদলেছেন। এতে নাখোশ হয়ে জাহাঙ্গীরকে দিয়ে ‘জাহাঙ্গীর খেলা’ শুরুর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন প্রভাবশালী ওই ছয় নেতা। এতে করে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে ভোটের মাঠে সংকটে ফেলা যাবে। এই সিটি নির্বাচনে পরাজিত হলে আজমত গাজীপুরের রাজনীতিতে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। এ ছাড়া গাজীপুর আওয়ামী লীগের যে অংশটি ‘জাহাঙ্গীর খেলা’র সঙ্গে জুটেছেন, তাদের লক্ষ্য জাহাঙ্গীরকেও শেষ করা যাবে এর মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও গাজীপুরের একাধিক নেতা এসব তথ্য জানান।
তারা বলেন, ‘জাহাঙ্গীর খেলা’ বলতে ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচন ঘিরে নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে আজমত উল্লা খানকে হারানো হয়েছিল তা। তখন মনোনয়নপ্রত্যাশী জাহাঙ্গীর আলমকে মনোনয়ন না দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ড নৌকা প্রতীক তুলে দেয় আজমতকে। তাতেই বেঁকে বসেন জাহাঙ্গীর অনুসারী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একাংশ এবং তাদের অনুসারী ছাত্রলীগের সাবেক প্রভাবশালী নেতারা। যারা জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে সুফলভোগী। এ অনুসারীদের চাপে পড়ে জাহাঙ্গীর ‘খেলা’ শুরু সেই নির্বাচনে। তিনি কাগজে-কলমে স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকলেও মুখে ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রার্থী হিসেবে না থাকার। এবারও একই খেলা, একই ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ‘জাহাঙ্গীর সিন্ডিকেট’।
গাজীপুর আওয়ামী লীগের একটি অংশ চায় ‘জাহাঙ্গীর খেলা’র মধ্য দিয়ে আজমত পরাজিত হলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শেষ হবে এবং ওই দোষে দুষ্ট হয়ে জাহাঙ্গীর আলমেরও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের মৃত্যু হবে। এই হিসাব থেকেও গাজীপুরের প্রভাবশালী নেতারা তার সঙ্গে জোট বেঁধেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, ‘সিদ্ধান্ত অমান্য করলে যত বড় নেতাই হোক না কেন, এবার আর ক্ষমা করা হবে না। সে যে-ই হোক। অনেকেই অমুক প্রার্থীর সঙ্গে তমুক প্রার্থীর সঙ্গে উসকানি দেন এমন ঘটনা বলাই যায়। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ হাতে থাকলে সবাইকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।’
২০১৩ সালের ‘জাহাঙ্গীর খেলা’ : গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এটি তৃতীয় নির্বাচন। ২০১৩ সালের প্রথম নির্বাচনে টঙ্গী পৌরসভার তিনবারের চেয়ারম্যান আজমত উল্লা খান বিএনপির আবদুল মান্নানের কাছে পরাজিত হন। সেবার মনোনয়ন চেয়েও না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন তরুণ নেতা জাহাঙ্গীর। তবে ভোটের আগে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যান। এর মধ্যে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার কথা কেন্দ্র থেকে বলা হলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু গণমাধ্যমে নানা আবেগী বক্তব্য দিয়ে যান ওই সময়ে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হওয়ার কয়েক দিন পর আত্মগোপন থেকে ছাত্রলীগের সাবেক কিছু প্রভাবশালী নেতা তাকে বের করে এনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে উপস্থিত করান। এতে করে সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা শেখ হাসিনার সুদৃষ্টিতে আসতে চেষ্টা করেন। ওই সময়ে সংসদ ভবনে কাজে থাকা শেখ হাসিনার সামনে জাহাঙ্গীর উপস্থিত হলে প্রধানমন্ত্রী তাকে আজমতের পক্ষে ভোট করার নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা জাহাঙ্গীরকে ভবিষ্যতে দেখার আশ্বাসও আদায় করে নেন।
দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার পরদিন জাহাঙ্গীর ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করে গাজীপুরবাসীকে আবেগপূর্ণ করে তোলেন। সংবাদ সম্মেলনের একপর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে ভোটের অল্প কয়েক দিন আগে গাজীপুরের মানুষকে দোলায় ফেলে দেন। অভিযোগ ওঠে, সংবাদ সম্মেলনের পর তিনি তার ঘনিষ্ঠ অনেকের কাছে বিএনপির তৎকালীন মেয়র প্রার্থী এমএ মান্নানের জন্য ভোট চান। ‘জাহাঙ্গীর খেলা’র উদ্দেশ্য ছিল আর যা-ই হোক, নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঠিক রাখতে হলে আজমতকে হারাতেই হবে। তাই জাহাঙ্গীর সিন্ডিকেট ওই নির্বাচনে শেষদিন পর্যন্ত রহস্যবৃত ছিল। ফলে ফলাফল যা হওয়ার কথা ছিল তা-ই হয়। মান্নানের কাছে পরাজিত হতে হয় আজমত উল্লা খানকে। অন্যদিকে নির্বাচন থেকে মুখে মুখে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলেও কাগজে-কলমে প্রার্থী থেকে যাওয়ার কারণে জাহাঙ্গীরের ভোটের বাক্সেও ৩০ হাজারের মতো ভোট পড়ে।
আজমত হেরে যাওয়ায় পরেরবার ২০১৮ সালে নৌকা পেতে আর কোনো ঝক্কি-ঝামেলায় পড়তে হয়নি জাহাঙ্গীর আলমকে। মনোনয়ন পেয়ে অনায়াসেই মেয়র হয়ে যান। তবে সেবার তিনি মনোনয়ন পেলেও প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কোনোভাবেই আজমত উল্লা খানের অসহযোগিতার অভিযোগ ওঠেনি। কেন্দ্রের কয়েকজন নেতার আজমতবিরোধী অবস্থানের নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, জাহাঙ্গীর বিভিন্ন নেতাকে আর্থিকসহ নানা সুবিধা দিয়ে তার ভক্ত করে রেখেছেন। অন্যদিকে আজমতের যোগ্য-দক্ষ ও ত্যাগের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন থাকায় অনেকেই তাকে ঈর্ষার চোখে দেখেন।
মেয়র হয়েই বেপরোয়া জাহাঙ্গীর : মেয়র হওয়ার পর পুরো নগরীতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার শুরু করেন জাহাঙ্গীর আলম। গাজীপুরের রাজনীতি, সিটি করপোরেশন কার্যালয়সহ সবই তার ইশারায় চলতে থাকে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতাসহ প্রভাবশালী অন্তত চারজন নেতা তাকে আশকারা দিতে থাকেন। তবে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় জাহাঙ্গীরকে। এরপর দুর্নীতির অভিযোগে মেয়র পদ থেকে অপসারণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কিছুটা চাপে পড়ে নিশ্চুপ হয়ে যান তিনি। সর্বশেষ দলীয় সিদ্ধান্তে বহিষ্কার হওয়া সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলে এর আওতায় তারও বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। এরপর মেয়র পদ ফিরে পেতে আদালতের শরণাপন্নও হন জাহাঙ্গীর। একই সঙ্গে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।