পরীমনির চোখের
জলে অনেকের চোখ ভিজেছে। অনেকের চোখ আবার কপালেও উঠেছে-‘ব্যাঙের আবার
সর্দি হয় কী করে?’ এই বলে। কিন্তু টিভি পর্দায় তার হাউমাউ
কান্না, বিচিত্র আবেগী সংলাপে নিতান্ত অবিশ্বাসীর মনেও এ বিশ্বাস জন্মেছিল, ‘মেয়েটির জীবনে
নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু ঘটেছে’। সেই কান্নার
ফলও নগদ। ১২ ঘণ্টা না পেরোতেই মামলা।
ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীকে
‘মা’ এবং আইজিপিকে ‘চলচ্চিত্র বন্ধু’ ডাকার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই প্রধান ও দ্বিতীয়
প্রধান আসামিসহ পাঁচজন গ্রেপ্তার। আর গণমাধ্যমের লাগাতার ও গনগনে প্রচারে পরীমনি রাতারাতি
বনে গেলেন ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি। সিনেমা নয়, ‘ধর্ষণচেষ্টা ও
হত্যাচেষ্টার’ মামলা দিয়ে সিনে পর্দার নায়িকা
বনে গেলেন জীবন পর্দার নায়িকা। কিন্ত গল্পটা যে থ্রিলার, এর পরতে পরতে যে এতটা ঠমক-চমক,
সাধারণ দর্শক দূরে থাক খোদ পরীমনিও বোধ হয় তখন ভাবতে পারেনি।
কেঁচো খুঁড়তে
গিয়েই বেরিয়ে এলো সাপ। জানা গেল, বোট ক্লাবের ঘটনার আগের দিন রাত পৌনে দুইটায় পরীমনি
মদের জন্য সদলবলে হানা দিয়ে ভাংচুর ও কর্মচারীদের মারধর করেছেন গুলশানের অল কমিউনিটি
ক্লাবে।
ক্লাব কর্তৃপক্ষের
বক্তব্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুটি ঘটনার চিত্রনাট্য প্রায় এক-গভীর রাতে নিয়মবহির্ভূতভাবে
বারে প্রবেশ, চাহিদা মোতাবেক মদ না পেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি-হট্টগোল, ক্লাবের লোকজনের
সঙ্গে বাকবিতণ্ডা, গায়ে হাত তোলা, ভাংচুর, ৯৯৯-এ ফোন দিয়ে উল্টো পুলিশ ডাকা, তারপর
প্রস্থান। দুই ঘটনার পার্থক্য একটাই-বোট ক্লাবে পাল্টা মার খেয়েছেন; কিন্তু কমিউনিটি
ক্লাবে পাল্টা মারটা খাননি, গুলশান থানার পুলিশের হস্তক্ষেপে অক্ষত শরীরে ফিরে আসেন।
গুলশান থানার
পুলিশ এ ঘটনার কেবল প্রত্যক্ষদর্শী নয়, ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বিবৃতিও দিয়েছে। তা
ছাড়া গোটা নেট দুনিয়া ওই ঘটনার ভিডিওতে সয়লাব। তারপরও পরীমনির দাবি, ‘এটা নাকি মিথ্যা,
ষড়যন্ত্রমূলক’। ধরে নিলাম, অভিযুক্ত নাসির আহমেদের
বক্তব্য মিথ্যা। কিন্ত অন্যরা? একজন পরীমনি বিভিন্ন বক্তব্যে বনানী থানা, গুলশান থানা,
ক্লাব কর্তৃপক্ষ, নিজের শিল্পী সমিতি, পরিচালক সমিতি থেকে ঘটনা সংশ্লিষ্ট প্রায় সবার
দিকেই অভিযোগের কামান দেগেছেন। সবার বক্তব্যকে ‘মিথ্যা’ আখ্যা দিচ্ছেন। তার মানে এক পরীমনিই সত্য,
বাকি সবাই-সবকিছু মিথ্যা?
চলুন একটু বিশ্লেষণ
করা যাক। তার বক্তব্যে অনেক কিছুই ধোঁয়াশাগ্রস্ত-
এ ক্ষেত্রে প্রধান
ধোঁয়াশা হলো, পরীমনির এত রাতে বোট ক্লাবে যাওয়ার কারণ কী? এজাহার এ বিষয়ে নিরুত্তর।
তবে প্রেস কনফারেন্সে একবার বলেছেন, অমির সঙ্গে একটা প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলতে বের হয়েছেন।
আরেকবার বলেছেন, কথিত বোন বনির মায়ের ওষুধ কিনে তাকে উত্তরার বাসায় পৌঁছে দিতে বের
হয়েছেন।
এ বিষয়ে শিল্পী
সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগরের বক্তব্যটা প্রাসঙ্গিক-‘পরীমনি এত রাতে
বোট ক্লাবে না গেলেও পারতেন। তিনি যে লেভেলের নায়িকা, ছবির কথা নিয়ে কোনো মিটিং করতে
হলেও প্রডিউসারকে তার কাছে যেতে হবে। সাইনিংয়ের জন্য হলে পরীর বাসায় গিয়ে সাইন করাতে
হবে। পরীর তাদের কাছে যাওয়া উচিত হয়নি।
তা ছাড়া মাঝ রাতে
‘প্রজেক্ট নিয়ে
আলোচনা’, জন্ম দেয় নানা প্রশ্নও ‘কিন্তু’। আর বনিকে বাসায় পৌঁছে দেওয়াই যদি বের
হওয়ার উদ্দেশ্য হয়, তাহলে প্রশ্ন, বনির মা অসুস্থ। তার হাতে ওষুধ। ওই অবস্থায় তাকে
মাঝ রাতে বোট ক্লাবে নিয়ে যাওয়া, সেখানে ১ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট অবস্থান-এ যুক্তি কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
মাঝ রাতে বোট
ক্লাবে যাওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে পরীমনি এজাহারে বলেন, ‘৮ জুন রাত সাড়ে
১১টায় বনানী থেকে উত্তরা যাওয়ার পথে অমি বলে, বেড়িবাঁধের ঢাকা বোট ক্লাব লিমিটেডে তার
দুই মিনিটের কাজ আছে। অমির কথা মতো আমরা ঢাকা বোট ক্লাবের সামনে গাড়ি দাঁড় করাই। কিন্তু
বোট ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অমি কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলে। তখন ঢাকা
বোট ক্লাবের সিকিউরিটি গার্ডরা গেট খুলে দেয়। তখন অমি ভেতরে যায় এবং অমি অনুরোধ করে,
এখানে পরিবেশ সুন্দর, তোমরা নামলে নামতে পার।’ এজাহারে পরী
আরও বলেন, ‘অমি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আমাকে আমার বর্তমান বাসা থেকে
ঢাকা বোট ক্লাবে নিয়ে যায়।
কিন্তু বোট ক্লাবের
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গাড়ি থেকে সবার আগে পরীমনিই নামেন। তারপর নামে অমি ও অন্যরা।
সবাই নামার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়িটি অন্যত্র চলে যায়। পরীমনি খুব স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিকভাবে
ক্লাবের ভেতরে যান। ভিডিওতে কোনোভাবে মনে হয় না, তাকে জোর করে নেওয়া হয়েছে বা ঘটনাটা
পূর্ব পরিকল্পিত। উল্টো তার শরীরি ভাষা (বডি ল্যাঙ্গুয়েজ), সবার স্বতঃস্ফূর্ত চলাফেরা
ও গাড়িগুলোর তৎক্ষণাত স্থান ত্যাগে মনে হয়, বোট ক্লাবই তাদের মাঝ রাতের গন্তব্য। তা
ছাড়া গভীর রাতে দলবলে ক্লাব বা বারে যাওয়াটা কী পরীমনির জন্য নতুন কিছু?
এজাহারে আরও বলা
হয়, অভিযুক্ত নাসির তাদের বারের ভেতরে ডেকে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেন। বিষয়টি এড়িয়ে
যেতে চাইলে পরীমনিকে জোর করে মদপান করান। মদের বারে রাত ১-২টার সময় কফির প্রস্তাব,
সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানে জোর করে মদ গেলানোর তথ্য-কতটা বিশ্বাসযোগ্য? তা ছাড়া জিমি,
কম বয়সি আরেক মেয়ে বনি ছিল। তাদের জোর করে মদ্যপান করাল না, একা শুধু পরীকেই করাল?
পরীমনির অভিযোগ
বনানী থানা তার মামলা নেয়নি। কিন্তু থানা কর্তৃপক্ষ বলছে ভিন্ন কথা-ওই রাতে ৩টা ২০
মিনিটের দিকে অপ্রকৃতস্থ, অসংলগ্ন ও ভারসাম্যহীন অবস্থায় অন্যের কাঁধে ভর করে পরীমনি
বনানী থানায় যান। অভিযোগ দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তাই সুস্থ হয়ে তাকে পরদিন সকালে
আসার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিনি আর থানায় আসেননি। সিসিটিভি ফুটেজে থানার বক্তব্যের
সত্যতা মেলে। সেখানে দেখা যায়, তিনি দাঁড়াতেই পারছিলেন না। বারবার পড়ে যাচ্ছিলেন।
পরীমনি দাবি করেন,
তাকে জোর করে খাওয়ানো মদের সঙ্গে অন্যকিছু মেশানো থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়ায়,
তিনি চিকিৎসা নিলেন না কেন? তার দাবি অনুযায়ী, ওই রাতে জিমি প্রচণ্ড আহত হন। তাহলে
তাকেও চিকিৎসা দেওয়া হলো না কেন? এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়েই বা ফেরত এলেন কেন? বনানী
থানার পুলিশ তো চিকিৎসার জন্য তাকে সাহায্যও করে।
চার দিন ধরে সবার
দ্বারে দ্বারে ঘুরেও পরীমনি নাকি কারও সাহায্য পাননি। বিশেষ করে শিল্পী সমিতির অসহযোগিতার
কথা বারবার বলেছেন। কিন্তু সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কণ্ঠে ভিন্ন সুর-পরীমনি
তাদের কোনো কিছু পরিষ্কার করে বলতে চায়নি। এক আইজিপির সাক্ষাৎ ছাড়া অন্য কোনো সহায়তা
চাননি। কিন্তু আইজিপি ঢাকার বাইরে থাকায় সাক্ষাৎটি বিলম্বিত হচ্ছিল। ওই সময় পরীমনি
নাকি কার্যত থানা বা মামলা-মোকদ্দমায় যেতেই চাননি। মামলার অন্যতম অভিযোগ ‘হত্যাচেষ্টা’ হলেও তার বিচিত্র বক্তব্য ও এজাহার এ
বিষয়ে নীরব।