সকাল ৯টা, ইউক্রেনের বন্দরনগরী ওডেসায় একসঙ্গে উচ্চৈস্বরে বাজতে শুরু করে মোবাইল ফোনগুলো। ‘ক্ষেপণাস্ত্র হামলার উচ্চ আশঙ্কা’ সম্পর্কে সতর্ক করছিল দেশটির রাষ্ট্রীয় জরুরি পরিষেবা। দ্রুততম সময়ে নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছিল তারা। দুপুর নাগাদ ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী জানায়, তারা ওই এলাকায় তিনটি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে। এর মধ্যে জাপোরিঝিয়া, ভিনিত্সা ও লভিভের মেয়ররা জানান, তাদের এলাকায় একাধিক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। এতে একটি বাঁধ এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থার কিছু অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের দাবি, রাশিয়ার ছোঁড়া ২০টি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে।
এটি ছিল ইউক্রেনজুড়ে রাশিয়ার ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দ্বিতীয়দিন। এর প্রথমদিন ছিল আরও বেশি ভয়ংকর। গত ১০ অক্টোবর মোট ৮৩টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল রুশ বাহিনী, যার আঘাতে প্রাণ হারান অন্তত ১৯ জন। ইউক্রেনীয় বাহিনী বলেছে, তারা ৪৩টি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে। এই কাজে দেশটি এখনো বুক ও এস-৩০০’র মতো সোভিয়েত আমলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া এর ভূপৃষ্ঠ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের মজুতও ক্রমেই শেষ হয়ে আসছে। সেই তুলনায় পশ্চিমাদের তৈরি যুদ্ধবিমান বিধ্বংসী এবং ক্ষেপণাস্ত্রবিরোধী ব্যবস্থাগুলো অনেক বেশি কার্যকর। গত ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই এগুলো পেতে চেষ্টা করছে ইউক্রেন। গত সোমবার রাশিয়ার সমন্বিত আক্রমণের পর ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এসময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ইউক্রেনে নতুন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যাচ্ছে।
কী পাচ্ছে ইউক্রেন: যুদ্ধের শুরুর দিকে ইসরায়েলের কাছে আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চেয়েছিলেন জেলেনস্কি। যদিও তিনি পরে স্বীকার করেছিলেন, রুশ আক্রমণ মোকাবিলায় আয়রন ডোম কার্যকর হবে না। কারণ এটি নকশা করা হয়েছে স্বল্পপাল্লার রকেট হামলা ঠেকানোর জন্য এবং তা খুব সীমিত এলাকা কভার করতে পারে। ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা চালাচ্ছে ক্যালিব্র এবং কেএইচ-১০১’র মতো দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে। এগুলো অল্প উচ্চতায় উড়তে পারে এবং রাডার ফাঁকি দিতে খুবই দক্ষ। রুশ বাহিনী ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং সম্ভবত কিনঝাল হাইপারসনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করছে। এ দুটোই আকারে অনেক বড় এবং আয়রন ডোমের নজর এড়াতে সক্ষম।
এ অবস্থায় ইউক্রেনের জন্য সুখবর হচ্ছে, পশ্চিমাদের তৈরি অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম ধাপে জার্মানির আইরিস-টি পাচ্ছে তারা। ইউক্রেন এর চারটি ব্যাটারি পাবে, যার প্রতিটিতে তিনটি লরি-ভর্তি লঞ্চার রয়েছে। এর একেকটি লঞ্চার ৪০ কিলোমিটার রেঞ্জের ২৪টি ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে। এটি প্রায় ২০ কিলোমিটার দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ইউক্রেনের বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষণ প্রধান ডেনিস স্মাজনি জানিয়েছেন, আইরিস-টির রাডার খুবই সংবেদনশীল। এটি ক্যালিব্রর মতো কম উচ্চতায় উড়ন্ত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো শনাক্ত ও ধ্বংস করতে পারবে।
ইউক্রেনে আইরিস-টির একাধিক ব্যাটারি মোতায়েনের মাধ্যমে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারের প্রধান রুটসহ ১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি প্রতিরক্ষা লাইন স্থাপন করা সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আইরিস-টির কমান্ড যানটি বিভিন্ন গ্রাউন্ড স্টেশন ও উড়োজাহাজ থেকে পাওয়া রাডারের তথ্যগুলোকে এক জায়গায় জমা করে। এর ফলে লক্ষ্যবস্তু যদি দেখা না-ও যায়, তবু সেটি মোকাবিলা করতে পারে ব্যাটারিগুলো। সোভিয়েত আমলের বুক এবং এস-৩০০ ব্যবস্থাগুলো কেবল তাদের নিজস্ব রাডারে ধরা পড়া লক্ষ্যবস্তুকেই মোকাবিলা করতে পারে। এছাড়া পুরোনো এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একটি একটি করে লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় ও তা ধ্বংস করে। সেখানে একটি আইরিস-টি ব্যাটারি তার ২৪টি ক্ষেপণাস্ত্রই একসঙ্গে ছুঁড়তে ও লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে পারে। এর ফলে জার্মান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটির চোখ ফাঁকি দেওয়া আরও কঠিন।
ইউক্রেন দ্বিতীয় যে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেতে যাচ্ছে তা হলো নরওয়ের নাসামস। আইরিস-টির মতো এটিও রাডার ডেটার একাধিক উৎসকে একটি স্থানে একীভূত করে। এটি যে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে তার নাম আমরাম। এটি কয়েক দশক ধরে ন্যাটোর এয়ার-টু-এয়ার কমব্যাট ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলে বিদ্যমান বিশাল মজুতের কারণে এই ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করাও সহজ হবে।
বাইডেন এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলেননি, তিনি ইউক্রেনকে কোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিতে চান। ইউক্রেন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক প্যাট্রিয়ট সারফেস-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনী কমান্ডের মুখপাত্র ইউরি ইগনাট বলছেন, আপাতত আমরা কেবল এই প্রযুক্তি পাওয়ার স্বপ্নই দেখতে পারি। প্রতিটি প্যাট্রিয়ট ব্যাটারির দাম ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি এবং এটি চালানোর জন্য কয়েক মাসের প্রশিক্ষণসহ কমপক্ষে ৭০ জন সৈন্যের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দেওয়ার মতো অতিরিক্ত প্যাট্রিয়ট নেইও। মার্কিন থিংক-ট্যাংক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের টম কারাকো বলেন, গত এক দশক বিমান ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষায় জোর না দেওয়ার ফল এটি। সেক্ষেত্রে বাইডেন হয়তো নাসামস ব্যবস্থা দেওয়ার গতি বাড়ানোর কথাই বলতে পারেন।
জার্মানি গত জুন মাসেই ইউক্রেনকে আইরিস-টি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু প্রযুক্তিগত কারণে এটি বিলম্বিত হয়। ইউক্রেনে প্রথমবার এই ধরনের ব্যবস্থা মোতায়েন হতে যাচ্ছে। ১১ অক্টোবর এর প্রথম চালান ইউক্রেনে পৌঁছেছে। আইরিস-টি মোতায়েন হলে ইউক্রেন রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার হার বাড়াতে সক্ষম হবে। অবশ্য রাশিয়ার ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আটকানো আইরিস-টি বা নাসামস উভয়েরই ক্ষমতার বাইরে। কয়েকশ কিলোমিটার রেঞ্জের ক্ষেপণাস্ত্রটি খুব উচ্চগতিতে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হনে। এর আকারও অনেক বড়। আইরিস-টির সব ক্ষেপণাস্ত্র মিলিয়ে ওজন হবে ১০০ কেজির মতো। সেখানে একটি ইস্কান্দার ক্ষেপণাস্ত্রের ওজনই হতে পারে ৭০০ কেজি। তাছাড়া রুশ ক্ষেপণাস্ত্রটি চলার পথে দিক পরিবর্তন করতে সক্ষম। এর ফলে সেটি চিহ্নিত করতে আরও বড় ও শক্তিশালী ইন্টারসেপ্টর প্রয়োজন হবে। স্মাজনির মতে, আপাতত রাশিয়ার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সর্বোত্তম সুরক্ষা হতে পারে কংক্রিট।