প্রতি বছর ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত
সুন্দরবনে প্রবেশ ও মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকে। মূলত এ সময়টাকে মাছের প্রজনন মৌসুম
হিসেবে ধরা হয়। তবে নিষেধাজ্ঞার মাঝেই বনের নদ-নদী ও খালে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার করছেন
একশ্রেণীর জেলেরা। এতে হুমকির মুখে পড়েছে বনের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য।
অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তার
যোগসাজশে সুন্দরবনসংলগ্ন জেলেরা বিষ দিয়ে মাছের পাশাপাশি কাঁকড়াও শিকার করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপকূলের প্রান্তিক মানুষের
জীবিকার প্রধান উৎস সুন্দরবন। বিষ প্রয়োগের ফলে পানি বিষাক্ত হয়ে অন্যান্য জলজ প্রাণীও
মারা যাচ্ছে। উদ্ভিদের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।
বন বিভাগের তথ্য বলছে, ১৩টি বড় নদীসহ ৪৫০টির
মতো খাল রয়েছে সুন্দরবনে। জোয়ারে পানিতে প্লাবিত হওয়া বনের জলাধার ভেটকি, রূপচাঁদা,
দাঁতিনা, চিত্রা, পাঙাশ, লইট্যা, ছুরি, মেদ, পাইস্যা, পোয়া, তপসে, লাক্ষা, কই, মাগুর,
কাইন, ইলিশসহ ২১০ প্রজাতির সাদা মাছের আবাস। এছাড়া রয়েছে গলদা, বাগদা, চাকা, চালী,
চামীসহ ২৪ প্রজাতির চিংড়ি। শিলাসহ ১৪ প্রজাতির কাঁকড়ার প্রজননও হয় এখানে। পাশাপাশি
এখানে ৪৩ প্রজাতির মালাস্কা ও এক প্রজাতির লবস্টার রয়েছে।
সুন্দরবনের সাধারণ জেলে ও বাওয়ালিদের অভিযোগ,
কিছু জেলে সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে বিষ দিয়ে মাছের পাশাপাশি কাঁকড়া শিকার করেন। এসব মাছ
ও কাঁকড়া আশপাশের এলাকার আড়ত এবং বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হয়। বনের ভেতরে কাঠ পুড়িয়ে
চলে শুঁটকি তৈরি। সম্প্রতি কয়রা ও দাকোপের ২০-২৫ জন মাছ ব্যবসায়ী বনের টহল ফাঁড়ির কর্মকর্তাদের
ম্যানেজ করে জেলে বহর নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছেন।
তবে বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবনকেন্দ্রিক
সব ধরনের অপরাধ দমনে সচেষ্ট তারা। ১ আগস্ট সুন্দরবনের জোলাখালীর খালে বিষ ছিটিয়ে শিকার
করা ৭০ কেজি চিংড়িসহ একটি নৌকা জব্দ করেছেন বন বিভাগের কর্মীরা। তবে এর সঙ্গে জড়িত
কাউকে আটক করতে পারেনি বন বিভাগ। তাছাড়া বনের মার্কি ও মান্দারবাড়ী এলাকায় এমন দুটি
স্থানের সন্ধান পেয়ে তা উচ্ছেদ করেছেন তারা। সেখানে গাছ কেটে তৈরি করা হয়েছে ফাঁকা
জায়গা। সুন্দরী, পশুর, গেওয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ সাজিয়ে বিশেষ কায়দায় বানানো হয়েছে
মাচা। এসব মাচার ওপর চিংড়ি রেখে নিচে তৈরি আরেকটি মাচায় গাছ রেখে আগুন দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায়
চিংড়ি শুকিয়ে তৈরি হয় শুঁটকি। গত বছরের ২২ জুলাই মান্দারবাড়ী খালসংলগ্ন এলাকায় গাছ
কেটে চিংড়ি শুকানোর একটি মাচার সন্ধান পান বন রক্ষীরা।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক
আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় এক শ্রেণীর
জেলে সুন্দরবনের ভেতরে ঢুকে বিষ দিয়ে মাছ ও কাঁকড়া শিকার করেন। এতে পানি বিষাক্ত হয়ে
অন্যান্য জলজপ্রাণীও মারা যাচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বনের জলজ জীববৈচিত্র্য।
উদ্ভিদের ওপরও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। উপকূলের প্রান্তিক মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস
সুন্দরবন। বন ঘিরে প্রায় দেড় লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। নিয়ম মেনে সুন্দরবন থেকে
সম্পদ আহরণ করা না হলে ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হবে। মাছ ও গাছ আশঙ্কাজনক কমে যাওয়ার কারণে
প্রান্তিক মানুষও জীবিকার উৎস হারাচ্ছে। এ কারণে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতাও বেড়েছে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও সুন্দরবন
বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবনের অর্থনৈতিক
গুরুত্ব অপরিসীম। তবে বনের ক্ষতি করে নয়। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতেই বনের
ভেতরে প্রবেশের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা। এটা যত জোরদার হবে ততই সুন্দরবনের জন্য ভালো। সুন্দরবন
সুরক্ষায় এর ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থানে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ এবং বনে
প্রবেশাধিকার আরো সংরক্ষিত হওয়া দরকার। অবস্থানগত কারণে খুলনার নয়টি উপজেলার মধ্যে
কয়রার বেশির ভাগ মানুষই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। এ জেলার সুন্দরবন প্রভাবিত অন্য
উপজেলাটি হলো দাকোপ। এ উপজেলা দুটির সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামগুলোর মানুষ মাছ, কাঁকড়া ধরে
জীবিকা নির্বাহ করে।’
এ বিষয়ে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির
কুমার দো বলেন, ‘নিষিদ্ধ মৌসুমে সুন্দরবনকেন্দ্রিক সব ধরনের
অপরাধ দমনে সচেষ্ট বনরক্ষীরা। এর মধ্যে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। দায়িত্ব পালনের
ক্ষেত্রে বনরক্ষীদের কারো বিরুদ্ধে অবহেলা অথবা অপরাধীর সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ প্রমাণিত
হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সুন্দরবন থেকে সরাসরি সম্পদ আহরণ করেন দুই থেকে তিন লাখ বনজীবী।
তাদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।’