নিজেদের জ্বালানি খাতে চীনের ব্যাপক নিয়ন্ত্রণকে ভাল চোখে দেখছে না ইরাক। খাতসংশ্লিষ্ঠদের ধারণা, চীনের আধিপত্যের কারণে অন্যান্য দেশের কাছে আকর্ষণ হারাচ্ছে ইরাকের জ্বালানি খাত। এমন পরিস্থিতিতে চীনের নিয়ন্ত্রণ কমানোর জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ইরাকের সরকার ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়। তবে এ পদক্ষেপ দেশটির অর্থনীতির জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
গত বছর ইরাকের জ্বালানি তেল মন্ত্রণালয় তিনটি সম্ভাব্য চুক্তি আটকে দেয়। এসব চুক্তির মাধ্যমে ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলোয় চীনের নিয়ন্ত্রন আরো জোরদার হওয়ার আশঙ্কা ছিল। উপসাগরীয় দেশটি ভঙ্গুর অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাড়ানোর জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশটি চীনের পরিবর্তে অন্যান্য আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
তথ্য বলছে, গত বছরের শুরু থেকেই রাশিয়ার লুকঅয়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তেল জায়ান্ট এক্সন মবিল ইরাকে অবস্থিত তাদের প্রধান তেলক্ষেত্রের শেয়ার চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির পরিকল্পনা করছে। কিন্তু ইরাকের জ্বালানি তেল মন্ত্রণালয়ের বাধার মুখে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে ব্রিটেনের জ্বালানি তেল প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামও (বিপি) ইরাকের জ্বালানি তেল উত্তোলন খাত থেকে নিজেদের সরিয়ে আনার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। ফলে এটিও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির কাছে তাদের তেলক্ষেত্রের শেয়ার বিক্রির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছিল। তবে ইরাকের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটিকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে রাজি করিয়েছে।
ইরাকের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক বিনিয়োগকারী চীন। বেইজিং এর বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) থেকে বাগদাদ সবচেয়ে বেশি সুবিধা লাভ করেছে। বিদ্যুকেন্দ্র ও বিমানবন্দরসহ পরিকাঠামো প্রকল্পগুলোর জন্য বিআরআইয়ের অধীনে ইরাকে ১ হাজার ৫০ কোটি ডলার অর্থায়ন করা হয়। কিন্তু যখনই প্রধান প্রধান জ্বালানি তেলক্ষেত্রগুলোয় নতুন বিনিয়োগের কথা আসছে তখনই চীনের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে ইরাক। দেশটির সরকার এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো চীনের হাতে নতুন করে জ্বালানি তেলক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ দিতে চাচ্ছে না। এর ফলে পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য ইরাকের জ্বালানি খাতে বিরাট জায়গা তৈরি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছর লুকঅয়েল ইরাকের সবচেয়ে বড় তেলক্ষেত্র ওয়েস্ট কারনা ২ এর শেয়ার চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি সিনোপ্যাকের কাছে বেঁচে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য ইরাকের জ্বালানি তেল মন্ত্রী ইহসান আব্দুল জাব্বার প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আলোচনা করেন। অন্যদিকে সিনোপ্যাকের কাছে ওয়েস্ট কারনা ১ এর শেয়ার বিক্রির চেষ্টা চালায় জ্বালানি জায়ান্ট এক্সন। এ প্রচেষ্টাও ভেস্তে দেয় ইরাকের জ্বালানি মন্ত্রণালয়। এছাড়া ইরাকে বিনিয়োগ রাখতে বিপিকে রাজি করিয়েছে মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠানটি তাদের রামাইলা তেলক্ষেত্রের শেয়ার চীনের একটি কোম্পানির কাছে বিক্রির চিন্তাভাবনা করছিল।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক ভূগর্ভস্থ মজুদের দিক থেকে পঞ্চম ইরাক। দেশটির মোট উত্তোলিত জ্বালানি তেলের প্রায় অর্ধেকই আসে রামাইলা ও ওয়েস্ট কারনা ক্ষেত্র থেকে। ইরাকের সরকারি দুটি সূত্র জানায়, জ্বালানি খাতে চীনের আধিপত্য বজায় থাকলে অন্যান্য দেশ থেকে বিনিয়োগ পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে সরকার। চীনের সঙ্গে ইরানের শক্তিশালী সম্পর্ক দেশটিকে ইরাকে ভাল অবস্থান তৈরিতে সহায়তা করেছে। কারণ ইরাকে তেহরানের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব রয়েছে। ইরাকের সরকারি আরেকটি সূত্র বলছে, ইরাকের জ্বালানি খাত চায়না-নিয়ন্ত্রিত জ্বালানি খাত হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিতি লাভ করুক, এটি আমরা চাই না। আমাদের সরকার ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ও এমনটাই ভাবছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত চার বছর ধরেই ইরাকের বেশির ভাগ জ্বালানি চুক্তি বাগিয়ে নিচ্ছে চীনের কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির তুলনায় চীন অনেক কম মুনাফা রাখছে। বিশ্লেষকদের দাবি, চায়না বিনিয়োগ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নেয়ার কৌশল ইরাকের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ চীন সরে আসলে অন্যান্য দেশ ইরাকে বিনিয়োগ বাড়াবে, এমন নিশ্চয়তা নেই।
২০১৭ সালে ইসলামিক স্টেট (আইএস) শাসনের পতন ঘটে। এর পর থেকেই দেশটির অর্থনীতিকে পুরনায় প্রবৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। ঠিক এমন সময় জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ উেস বড় পরিবর্তন অর্থনীতির জন্য হুমকি বয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।