চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাটে ফেরি চলাচল শুরু করেছে। চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে আওতাধীন কালুরঘাট ফেরিঘাটের কার্যক্রম শুক্রবার থেকে শুরু করা হয়েছে। কালুরঘাট সেতুতে যানজট ও নদী পারাপারকারীদের ভোগান্তি কমাতে কালুরঘাট সেতুর নিচ দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে ফেরি চালুর সিদ্ধান্ত নেয় সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)।
ফেরি চলাচল করার ফলে বড় গাড়িগুলো ফেরিতে দিয়ে চলাচল করছে। চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগাধীন কর্ণফুলী নদীর উপর কালুরঘাট ফেরী ঘাটে (ফেরীতে ইজারাদার কর্তৃক লুব্রিকেন্ট ও জ্বালানী সরবরাহসহ) পারাপারকারী যানবাহন হইতে ইজারার মাধ্যমে মাশুল আদায়ের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। এই কার্যক্রমের জন্য টেন্ডার ও ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জরাজীর্ণ কালুরঘাট সেতু এলাকা পারাপারে যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ এবং ভারী যানবাহন এড়াতে চলাচল শুরু হয়েছে। চট্টগ্রামের ৯২ বছরের পুরনো কালুরঘাট সেতুটি সংস্কার করছে রেলওয়ে। এবার সংস্কারকাজে ৫৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। দোহাজারী-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চলাচল শুরুর আগে সেতু মজবুত করতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে সড়ক ও জনপত বিভাগ কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাট এলাকায় তিনটি ফেরি এনেছে। কালুরঘাট সেতুর উভয় পাশে অ্যাপ্রোচ সড়কের নির্মাণকাজ হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, কালুরঘাট সেতুটি অনেক পুরোনো হওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। সেতুটি একমুখী হওয়ায় এতে যান চলাচলে বেগ পেতে হচ্ছে। প্রায় সময়ই সেখানে যানজট লেগে থাকে। যাত্রীদের পারাপারে ভোগান্তি কমাতে ফেরি চলাচলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে বড় গাড়িগুলো ফেরিতে পারাপার হবে। ফলে কালুরঘাট সেতুর উভয় পাশের যানজট কমে আসবে।’
ফেরী চলাচল কার্যক্রম শুরু করার সময় উপস্থিত ছিলেন সওজ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহেদ হোসেন, সওজ কারখানা বিভাগ নির্বাহী প্রকৌশলী সিফাত আফরিন, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নিজাম উদ্দিন, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো: আব্দুল্লাহ আল নোমান পারভেজ, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো: আব্দুল মালেক চৌধুরী, সহকারী প্রকৌশলী সেগুন প্রসাদ বড়ুয়াসহ সড়ক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ও এলাকার জনসাধারণ।
কালুরঘাট ফেরীঘাটে ফেরী পারাপারের জন্য মোট তিনটি ফেরীর ব্যবস্থা রয়েছে। এতে ২টি ফেরী সবসময় চলাচল করবে এবং ১টি ফেরী ষ্ট্যান্ড বাই থাকবে।
ফেরী পারাপারের যানবাহনের জন্য টোলের হার নির্ধারণ করেছে চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ)। কালুরঘাট ফেরী পারাপারকারী প্রতিযানবাহন হইতে টোলের হার- ট্রেইলার ৫৬৫ টাকা, হেভী ট্রাক/ কাভার্ড ভ্যান ৪৫০ টাকা, মিডিয়াম ট্রাক (২ এক্সেল বিশিষ্ট) ২২৫ টাকা, বড় বাস (চালক ব্যতীত ৩১ অথবা তদুর্ধ্ব আসন) ২০৫ টাকা, মিনি ট্রাক ১৭০ টাকা, কৃষি কাজে ব্যবহৃত যান (পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর) ১৩৫ টাকা, মিনিবাস/কোস্টার (৩০ জন যাত্রী বহনের উপযোগী) ১১৫ টাকা, মাইক্রোবাস (৮ হতে ১৫ জন যাত্রী) ৯০ টাকা, ফোর হুইল চালিত যানবাহন (পিকআপ, কনভারশনকৃত জীপ, রেকার) ৯০ টাকা, সিডার কার ৫৫ টাকা, অটোভ্যান ও ব্যাটারি চালিত ৩/৪ চাকার মোটরাইজ যান ২৫ টাকা, মোটর সাইকেল ১০ টাকা, রিক্সা/ভ্যান/বাইসাইকেল/ঠেলাগাড়ী ৫ টাকা।
রেলওয়ের প্রকৌশলীরা জানান, ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুর সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরামর্শক দলের সুপারিশ অনুযায়ী সংস্কার করা হচ্ছে। বর্তমানে সেতু দিয়ে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইনে ১০ টন ভারী ইঞ্জিন চলাচল করে। সেতু পার হওয়ার সময় গতি থাকে সর্বোচ্চ ১০ কিলোমিটার। তবে কক্সবাজারগামী ইঞ্জিনের ওজন হবে ১২-১৫ টন। ট্রেনের গতি হবে ৮০-১০০ কিলোমিটার। এর আগে ২০০৪ সালের ১৩ আগস্ট ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতুতে বড় ধরনের সংস্কার কাজ করা হয়েছিল। এরপর ২০১২ সালে আরেক দফা সংস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু কক্সবাজারগামী ট্রেনের ইঞ্জিনের ওজন হবে ১২-১৫ টন। ট্রেনের গতি সর্বোচ্চ ৮০-১০০ কিলোমিটার। কালুরঘাট সেতুর বর্তমান অবস্থার কারণে এই গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব হবে না। কিন্তু ৪০-৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা আছে। এ জন্য বুয়েটের পরামর্শক দলের পরামর্শ অনুযায়ী সেতু সংস্কার করা হচ্ছে।
দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, প্রকল্পের অগ্রগতি শেষ পর্যায়ে। রেললাইনের ওপর থাকা ছোট-বড় ব্রিজ-কালভার্টের কাজও শেষ হয়েছে। এখন মেকানিক্যালের কাজ চলমান আছে।’ যানবাহন পারাপারের জন্য কর্ণফুলী নদীতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে দুটি ফেরি।
২০১১ সালের ৩ এপ্রিল দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত মিটারগেজ রেলপথ নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু পর্যন্ত ৮৮ কিলোমিটার এবং রামু থেকে কক্সবাজার ১২ কিলোমিটার। প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনের প্রায় সাত বছর পর ২০১৮ সালে ডুয়েল গেজ এবং সিঙ্গেল ট্র্যাক রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার রামু পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে প্রথমে ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এতে অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও বাংলাদেশ সরকার।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১৯৩১ সালে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতু নির্মাণ করে ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি নামের সেতু নির্মাণকারী একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগের জন্য এই সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল। যদিও পরে দোহাজারী পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয় এই রেললাইন। ৬৩৮ মিটার দীর্ঘ এই সেতুটি ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০০৪ ও ২০১২ সালে দুই দফায় সেতুটি সংস্কার করেছিল রেলওয়ে। কিন্তু এরপরও সেতুটির অবস্থা জরাজীর্ণ। এ অবস্থায় সেতুটির ওপর দিয়ে ট্রেনের পাশাপাশি দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী ও পটিয়াগামী গাড়িও চলাচল করে। ট্রেন চলাচল করলে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। একমুখী যান চলাচলের কারণে সব সময় যানজট লেগে থাকে। যাত্রী ও চালকদের প্রচণ্ড ভোগান্তি পোহাতে হয়।