দ্রব্যমূল্যের চলমান ঊর্ধ্বমুখিনতায় সবচেয়ে বেশি কষ্টের মধ্যে পড়েছেন শ্রমিকেরা। তাঁদের সরকার নির্ধারিত যে ন্যূনতম মজুরি দেওয়া হয়, তা এই বাজারে জীবনধারণের জন্য বেশ অপ্রতুল। কারণ, শ্রমিকদের মজুরি যে হারে বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। অর্থাৎ মজুরির চেয়ে এখন মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এতে শ্রমিকের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
বর্তমানে ৪২টি খাতের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা আছে। এর মধ্যে ১৮টি খাতের ন্যূনতম মজুরিকাঠামোর নির্ধারিত পাঁচ বছর সময়সীমা পেরিয়ে গেছে। নতুন মজুরিকাঠামো পাচ্ছেন না এসব খাতের শ্রমিকেরা। এর মধ্যে ১০টির মেয়াদ ১০ বছর পেরিয়েছে। এ দেশে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করেন পোশাক খাতে। এই খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। তাঁদের জন্য ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। সে অনুযায়ী একজন পোশাকশ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা। একজন পোশাকশ্রমিক যখন কাজ শুরু করেন, তখন এই মজুরি পান। প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে মূল মজুরি বৃদ্ধি পায়। শ্রমিকেরা চাল, ডাল, তেল, নুন, সবজিসহ খাবার কিনতেই মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি অনুভব করেন। বিশেষ করে চালের দাম বাড়লেই তাঁদের জীবন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। এখন প্রায় সব জিনিসের দামই বাড়ছে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মোট চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৮ টাকা। এখন তা ৬০ টাকা। গত সাড়ে চার বছরে শুধু চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫৮ শতাংশ।
ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সাবেক মহাসচিব সালাউদ্দিন স্বপন বলেন, জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের শ্রমিকগোষ্ঠীর জীবনধারণে নাভিশ্বাস উঠছে। গত দুই বছরে তাদের ক্রয়ক্ষমতা ২০ শতাংশের মতো কমেছে। এই অবস্থায় তিনি শ্রমিকদের জীবনধারণের সুবিধার্থে মহার্ঘ ভাতা প্রদান কিংবা রেশন চালুর দাবি জানান।
১৮ খাতের মেয়াদ পেরিয়েছে: বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত ন্যূনতম মজুরিকাঠামোর মেয়াদ সাধারণত পাঁচ বছর। ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮ খাতের মজুরিকাঠামোর সময়সীমা পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এই খাতগুলো হলো টাইপ ফাউন্ড্রি; পেট্রলপাম্প; আয়ুর্বেদিক কারখানা; আয়রন ফাউন্ড্রি ও প্রকৌশল ওয়ার্কশপ; চা-বাগান; তেল কারখানা ও সবজি উৎপাদন; হোমিওপ্যাথ কারখানা; সল্ট ক্রাশিং; কোল্ড স্টোরেজ; ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত অদক্ষ প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক ও কিশোর শ্রমিক; ব্যক্তিমালিকানাধীন পাটকল; রাবারশিল্প; সিনেমা হল; ম্যাচশিল্প; জুট প্রেস অ্যান্ড বেলিং; মৎস্যশিকারি (মাছ ধরার ট্রলারে কাজ করেন); বিড়ি; বাংলাদেশ স্থলবন্দর। এসব খাতের সর্বশেষ মজুরি হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৬ সালের আগে। এর মধ্যে কোনোটির মেয়াদ দশক পেরিয়েছে। এসব খাতের ন্যূনতম মজুরি ৫২১ থেকে ৭ হাজার ৪২০ টাকার মধ্যে। তবে দেশের বিরাট শ্রমিকগোষ্ঠী এখনো সরকার নির্ধারিত মজুরিকাঠামোর বাইরে রয়ে গেছে। তাঁরা মূলত অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। তাঁরাও জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যের এই সময়ে ভীষণ কষ্টে আছেন।
মজুরির চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি বাড়ছে: জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি তথা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাঁদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতি ও জাতীয় মজুরি সূচক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাধারণত মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশি থাকে। কিন্তু কয়েক মাস ধরেই এর ব্যতিক্রম চলছে। গত জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ, সেখানে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর মধ্যে নির্মাণ খাতের শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম বেড়েছে। এই খাতে মজুরি বৃদ্ধির হার ৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, যা সার্বিক মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম। এর মানে, যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, সেই হারে মজুরি বাড়ছে না।