বর্ষা মৌসুমের আগেই কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জে তীব্র হয়ে উঠেছে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন। অব্যাহত এ ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে নদের তীরবর্তী বাসিন্দারা। প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে অব্যাহত রয়েছে এ ভাঙন। ভাঙনে ঐতিহ্যবাহী মোল্লারহাটসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পানি কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক দিনে উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙন তীব্র হয়ে উঠেছে। ইউনিয়নের বালাডোবা, চিতলিয়া, শেখ পালানু, পূর্ব দুর্গাপুর গ্রাম ও মোল্ল্যারহাট এলাকার পার্শ্ববর্তী পাঁচটি গ্রামের প্রায় শতাধিক ঘর-বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনে নদীতে চলে গেছে মোল্লারহাট বাজারের অর্ধেক অংশ। প্রতিদিনই ভাঙনে বিলীন হচ্ছে গাছপালাসহ ফসলি জমি। হুমকিতে পড়েছে বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিষদ ভবন, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ চারটি মাদ্রাসা।
সরেজমিনে বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ভোগলের কুটি গ্রামে গেলে দেখা যায, ফারুক মোল্ল্যার (৫০) বাড়ির অর্ধেক নদীতে বিলীন হয়েছে। বাকি অর্ধেক ভিটায় একটি ঘরে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন তারা। দিনে ঘর সরানোর কাজ করছেন। ফারুক মোল্ল্যা জানান, ব্রহ্মপুত্র নদে এর আগে মোট পাঁচবার বাড়ি ভেঙেছে তার। এবার নিয়ে ছয় বার। তীব্র ভাঙনের কবলে পড়ে একটি ঘরের বেড়া, চাল খুলে সরিয়ে অন্যের জায়গায় রেখেছেন। দু-একদিনের মধ্যে বাকি ঘরও সরাতে হবে। কিন্তু ভিটেমাটি চলে গেলে কোথায় আশ্রয় নেবেন সে জায়গা এখনো খুঁজে পাননি তিনি।
একই এলাকার ভোগলের কুটি গ্রামের মরিয়ম বেগমের (২৭) একই অবস্থা। ঘর একেবারেই ব্রহ্মপুত্রের কিনারে ভাঙনের মুখে পড়ে আছে। মরিয়ম বেগম জানান, বাড়িতে আর থাকার উপায় নেই। কখন যে পুরো ভিটাটাই চলে যায় ঠিক নেই। এ কারণে বাড়ির অনেক কিছুই সরিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখেছেন তিনি। কিন্তু কোথায় ঠিকানা হবে সেটা জানা নেই। বললেন আগে বাড়ি ভাঙনে পার্শ্ববর্তী কোথায় জায়গা করে নিলেই হতো। এখন অনেক টাকা দিয়ে সে জায়গা নিতে হয়। টাকা দেয়ারও উপায় নেই। বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের কড্ডার মোড় এলাকার চায়না বেগম ও আসাম উদ্দিন জানান, প্রতি বছরই শুনি সরকার নদী বেঁধে দেয় কিন্তু দেয় না। এখন বাড়ি ভেঙে যাওয়ায় মানুষের জায়গায় আশ্রয় নিয়ে আছি। কোনো সাহায্য সহযোগিতাও পাচ্ছি না।
বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের সদস্য শফিকুল ইসলাম জানান, যেভাবে ভাঙন শুরু হয়েছে তাতে ভাঙনরোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে অল্প সময়ের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী মোল্লারহাটসহ প্রায় তিন কিলোমিটারের বেশি এলাকায় বেশকিছু গ্রাম নদীগর্ভে চলে যাবে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো অনেকটাই খোলা আকাশের নিচে ও অন্যের জায়গায় কোনো রকমে আশ্রয় নিয়ে দিনযাপন করছে। অন্যদিকে হুমকিতে থাকা পরিবারগুলো জানায়, ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে কয়েক দফা বসতভিটা হারানোর পর এবার শেষ আশ্রয়টুকুও থাকবে না তাদের।
এ পরিস্থিতিতে এলাকাবাসীসহ জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেও কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে নদী পাড়ে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন। ঘর-বাড়ি, ফসলী জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা রক্ষা করতে বর্ষার আগেই ভাঙনরোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয়রা।
উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. বাবলু মিয়া জানান, ব্রহ্মপুত্রের এ তীব্র ভাঙন বন্ধের জন্য আমি এলাকাবাসীকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তাসহ জেলা প্রশাসক ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ-আল-মামুন জানান, বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মোল্লারহাট এলাকা গত বছরও ভাঙনকবলিত হয়েছিল। আমরা সেখানে জরুরি ভিত্তিতে কাজ করেছি। এবার হঠাৎ পানি বৃদ্ধির কারণে সেখানে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। এ পরিস্থিতিতে আমরা জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে এলাকা পরিদর্শন করে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি। বরাদ্দ পেলেই দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।