মাদ্রাসাগুলোয় দিনের পর দিন ছেলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চললেও তা বন্ধে এখনও তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বিপথগামী কিছু শিক্ষক ও মাদ্রাসাসংশ্নিষ্টরা এটাকে অপরাধ বলেই গণ্য করেন না
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার বড়খারচর আদর্শ নূরানী হাফিজিয়া মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে শিশুটি। গত ১ এপ্রিল হঠাৎ বাড়ি চলে আসে। তার শরীরে তখন অনেক জ্বর। ওষুধ খাইয়ে কিছুটা সুস্থ করে তোলার পর তাকে মাদ্রাসায় যেতে বলা হয়। কিন্তু কিছুতেই সে যেতে রাজি হয় না। গত বুধবার জোর করে তাকে নিয়ে যাওয়া হলে সে মাদ্রাসার গেটে দাঁড়িয়ে শিক্ষক ইয়াকুব আলীকে গালাগাল শুরু করে। এরপর দৌড়ে চলে যায় থানার সামনে। সেখানে মাকে বলে, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাবে সে। তখন বেরিয়ে আসে তার ওপর হওয়া পাশবিক নির্যাতনের কথা। ওই শিক্ষক একাধিকবার তাকে বলাৎকার করে তা গোপন রাখতে হুমকি দিয়েছেন বলেও জানায় সে।
এরকম ঘটনা শুধু একটি নয়, দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসায় বহু ছেলেশিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অভিযোগ কখনও শিক্ষক, কখনও সিনিয়র ছাত্র বা মাদ্রাসাসংশ্নিষ্ট কারও বিরুদ্ধে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর মাদ্রাসায় ধর্ষণের শিকার হয়েছে অন্তত ৫২ শিশু। এর মধ্যে তিনজন মারা গেছে। এ ছাড়া চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে আরও ১০ শিশু।
আসকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা বলেন, ছেলেশিশুদের ধর্ষণের ক্ষেত্রে এখনও বলাৎকার শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তবে তা ঘটনাটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে। অনেকেই মনে করেন, এটা তো বলাৎকার, ধর্ষণ না। গুরুতর কোনো অপরাধ না। আসলে ধর্ষণ তো ধর্ষণই, তা সে ছেলেশিশুর সঙ্গে হোক বা মেয়ে। এর বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। শীপা বলেন, আইনের মাধ্যমে সমস্যাটিকে শনাক্ত করে সমাধান খুঁজতে হবে। সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে প্রচলিত আইন পর্যালোচনা করে ছেলেশিশু ধর্ষণ বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম) সোহেল রানা বলেন, বলাৎকার বা ছেলেশিশু ধর্ষণের ঘটনা বন্ধে আমরা ফেসবুক পেজগুলোর মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক নানা বার্তা দিয়ে যাচ্ছি। এ ছাড়া অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব করে না পুলিশ। তবে এ সমস্যা রোধে ব্যাপক সামাজিক সচেতনতা প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মাদ্রাসাগুলোয় দিনের পর দিন ছেলে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চললেও তা বন্ধে এখনও তেমন কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বিপথগামী কিছু শিক্ষক ও মাদ্রাসাসংশ্নিষ্টরা এটাকে অপরাধ বলেই গণ্য করেন না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের অপরাধ আড়াল করতে ধর্মের নানা অপব্যাখ্যা দেন জড়িতরা। আবার ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করে রেখে তা ছড়ানোর ভয় দেখিয়ে শিশুদের জিম্মি করার ঘটনাও রয়েছে। গত ৭ এপ্রিল সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার বাজারগ্রামের কফিল উদ্দিন হাফিজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক আনোয়ারুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি এক শিশুর সঙ্গে বিকৃত যৌনাচারের ভিডিও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। গ্রেপ্তারের পর তার মোবাইল ফোনে আরও কয়েক শিশুর সঙ্গে একই অপকর্মের ভিডিও পাওয়া যায়। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক ইয়াছিন আলম চৌধুরী জানান, বলাৎকারের দৃশ্য তিনি মোবাইল ফোনে ধারণ করে ওই শিশুদের ভয় দেখিয়ে আবারও বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হতে বাধ্য করতেন।
এর আগে গত বছরের ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার আহমদিয়া আজিজুল উলুম মাদ্রাসার হোস্টেল সুপার নাছির উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা জানান, কবে কোন ছাত্রকে বলাৎকার করবেন রীতিমতো তার রুটিন তৈরি করেছিলেন তিনি। কোনো ছাত্র রাজি না হলে তার ওপর চালানো হতো নির্যাতন। পরে ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। তাদের মধ্যে চার ছাত্র আদালতে ২২ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে নাছিরের পাশবিকতার বর্ণনা দেয়।
নয় বছর ধরে ধর্ষণ :২০১৯ সালের ২২ জুলাই রাজধানীর দক্ষিণখানের মাদ্রাসাশিক্ষক ইদ্রিস আহমেদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তার বিরুদ্ধে এক শিশু নয় বছর ধরে ধর্ষণ চালানোর অভিযোগ করে। ২০১০ সালে শিশুটি মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। তখন তার বয়স ১২ বছর, যৌননির্যাতনের শিকার তখন থেকেই। ৯ বছর পর শিশুটি তার চাচাত ভাইকে ঘটনাটি জানায়। এরপর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।