মানিকগঞ্জের
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে ঝিটকার ‘হাজারি গুড়’র নাম।
এ গুড়ের সুনাম রয়েছে এশিয়া থেকে ইউরোপ মহাদেশে।
শুধু
তাই নয় গুড় তৈরি নিয়ে রয়েছে নানা রূপকথা।
জানা
যায়, কয়েকশ’ বছর আগে ঝিটকা এলাকায় হাজারি প্রামানিক নামে এক
গাছি ছিলেন। তিনি খেজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করতেন। একদিন বিকেলে তিনি খেজুর গাছে হাঁড়ি
বসিয়ে নামা মাত্রই এক দরবেশ এসে হাজির হন তার সামনে এবং কাঁচা রস খেতে চান তার কাছে।
তখন তিনি বলেন সবেমাত্র গাছে হাঁড়ি বসিয়েছি এতো অল্প সময়ে বড় জোর ১০-১৫ ফোঁটা রস হাড়িতে
পড়েছে তবুও দরবেশ রস খেতে চান। তখন হাজারি প্রামানিক খেজুর গাছে ওঠেন এবং দেখতে পান
সারারাত ধরে যতো রস পড়তো সে পরিমাণ রসে হাড়ি ভরে গেছে। গাছি হাড়ি ভরপুর রস নিয়ে নিচে
নেমে ওই দরবেশকে রস খাওয়ান এবং পা জড়িয়ে ধরেন।
গাছিকে
বুকে জড়িয়ে নিয়ে দরবেশ বলেন, ‘কাল থেকে তুই যে গুড় তৈরি করবি তা সবাই খাবে এবং
তোর গুড়ের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তোর সাত পুরুষ এ গুড়ের সুনাম ধরে রাখবে’ বলেই দরবেশ দ্রুত চলে যান। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওই দরবেশকে পাওয়া
যায়নি। এরপর থেকেই গুড়ের নামকরণ করা হয় ‘হাজারি গুড়’।
রানি এলিজাবেথকে নিয়ে প্রচলিত কল্পকাহিনী:
যুগটি
ছিলো ভারত বর্ষের সম্রাট আকবরের স্বর্ণযুগ। তখন ব্রিটিশ রানি এলিজাবেথ ভারতবর্ষ সফরে
আসেন। শত বছরের জনশ্রুতি মতে, মানিকগঞ্জ অঞ্চলের গুড়ের ঘ্রাণ ও স্বাদে মুগ্ধ হয়েছিলেন
রানি, গুড় হাতে নিয়ে একটু চাপ দিতেই হাজার টুকরো হয়ে গিয়েছিল। রানি এলিজাবেথ গুড় খেয়ে
এতই মজা পেয়েছিলেন যে, গুণমুগ্ধতা প্রকাশ করতে আগ্রহী হয়ে ‘হাজারি’ নামে একটি সিলমোহর তৈরি করে দিয়ে গেছেন এবং তিনি
নিজেই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এ গুড়ের নাম।
হাজারি
গুড় তৈরির পদ্ধতি:
বিকেল ও সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত্বে যেকোনো সময় গাছি হাড়ি বসান খেজুর গাছে। পৌষের প্রথম থেকেই আসমান ছোঁয়া খেজুর গাছ থেকে ভোর বেলায় গাছি মাটির তৈরি হাড়িতে করে রস নামায়। রস নামানোর পর তা নিয়ে যাওয়া হয় গাছি বাড়িতে তারপর রস নামিয়ে ছেকে ময়লা পরিস্কার করে আদি প্রক্রিয়ায় টিনের তাফালে (পাত্র) করে মাটির চুলায় রস জ্বাল দিয়ে ঘন করতে হয়। রসের ঘনত্ব বেড়ে গেলে একটি মাটির হাড়িতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘুটে ঘুটে তৈরি করা হয় সাদা রঙের হাজারি গুড়।
হাজারি গুড়ের মূল্য:
প্রচুর
চাহিদা ও উৎপাদন কম হওয়ায় হাজারি গুড়ের ক্রেতা সব সময় থাকে গাছি বাড়িতে। এক কেজি গুড়
নিতে অর্ডার করতে হয় সপ্তাহ খানেক আগে। ১২ লিটার রসে প্রায় এক কেজি গুড় তৈরি হয় যে
কারণে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক ক্রেতা আসেন সেই ঐতিহ্যবাহী গুড় নিতে। অন্য গুড়ের তুলনায়
হাজারি গুড়ের দাম বেশি। স্বাদও অন্য কোনো গুড়ের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। বর্তমানে প্রতি
কেজি হাজারি গুড় বিক্রি হয় ১৪৫০-১৫০০ টাকায়।
সরেজমিনে
গিয়ে দেখা যায়, শীতের প্রথম থেকেই খেজুর গাছ কাটা থেকে শুরু করে কাচা রস নামাতে ব্যস্ত
পার করছেন গাছিরা। ভোর থেকে শুরু হয় রস নামানোর কাজ। গাছি রস নামিয়ে নিয়ে যান হাজারি
বাড়ি। এরপর হাজারি পরিবারের গৃহিণীরা রস ছেকে টিনের পাত্রে (তাফেল) ঢালেন। তারপর মাটির
তৈরি চুলায় জ্বাল দেওয়া হয়। রসের ঘনত্ব বাড়লে মাটির তৈরি পাত্রে ঢেলে হাতল দিয়ে ঘোটা
হয়। পরে তা একটি পাত্রে পরিমাণ মতো করে ঢেলে হাজারি গুড় তৈরির কাজ সম্পন্ন কনেন হাজারি
পরিবারের পুরুষরা।
মকবুল
হোসেন হাজারির ছেলে ৯৩ বছর বয়সী আবুল কাশেম হাজারি বলেন, আমার দাদার কাছে শুনেছি এই
হাজারি গুড় তার দাদার বাবা নাকি প্রথম তৈরি করেন তারপর থেকে আমরা বংশ পরাক্রমে এ গুড়
তৈরি করে আসছি। আগের মতো খেজুর গাছ না থাকায় এখন আর অনেক গুড় তৈরি করতে পারছিনা। অন্যদিকে,
কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা হাজারির সিল ব্যবহার করে নকল গুড় তৈরি করে বাজারে ছাড়ছেন।
আবুল
কাশেম হাজারির ছেলে শাহিন হাজারি বলেন, ছোট বেলায় যে পরিমাণ খেজুর গাছ ছিলো সেই তুলনায়
এখন গাছ নেই বললেই চলে। এ বছর ১৪০টি খেজুর গাছ কেটেছি। প্রতিটি গাছ আকার ভেদে ৫০০-
১০০ টাকা করে দিয়েছি। ভোরে গাছ থেকে রস নামিয়ে গুড় তৈরি প্রক্রিয়া করছি এবং প্রতি ১২
লিটারের প্রায় এক কেজি করে গুড় তৈরি করতে পারছি। সকাল থেকে গুড় নিতে দেশের বিভিন্ন
স্থান থেকে লোক আসছে কিন্তু উৎপাদন কম হওয়ায় সবাইকে গুড় দিতে পারছি না। অনেকে আবার
এক মাস আগেই অর্ডার দেন। এখন প্রতি কেজি গুড় ১৪৫০-১৫০০ টাকায় বিক্রি করছি।
মানিকগঞ্জের
জেলা প্রশাসক এসএম ফেরদৌস বলেন, জেলার ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘ঝিটকার হাজারি গুড়’। সে কারণে নতুন করে খেজুর গাছ লাগানো ও গাছিদের
সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এবং ঐতিহ্য বহন করায় সরকারিভাবে মানিকগঞ্জ জেলাকে হাজারি গুড়ে ব্রান্ডিং
করা হয়েছে।