জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হয়েছে।স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রিয় স্বদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট মহাকাশে উড়ছে। দ্রুত বাস্তবায়ন হচ্ছে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে প্রথম তলদেশ সুরঙ্গ বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ ইত্যাদি। এবার উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে স্বপ্নের ঢাকা মেট্রোরেল। এর মাধ্যমে বাঙালির আরেকটি স্বপ্নপূরণ হতে যাচ্ছে। ২৮ ডিসেম্বর ২০২২ইং তারিখ, বুধবার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা মেট্রোরেলের শুভ উদ্বোধন করবেন। বাংলাদেশের সমগ্র জাতি এই শুভদিনের শুভক্ষণের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মাধ্যমে আবারো প্রমাণিত হলো বঙ্গবন্ধু কন্যা বিশ্বনেতা শেখ হাসিনা যেমন জাতিকে স্বপ্ন দেখাতে জানেন, তেমনই তিনি জানেন কীভাবে স্বপ্নকে সকল বাধা অতিক্রম করে বাস্তবায়ন করতে হয়। মেট্রোরেল চালুর মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে রাজধানীর গণপরিবহনে নব দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। যানজটের নগরী ঢাকায় যানজট নিরসনে যে বিরাট ভূমিকা রাখবে স্বপ্নের মেট্রোরেল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর মাধ্যমে নগরবাসীর অর্থ, সময় যেমন সাশ্রয় হবে তেমন যাতায়াতের দুর্ভোগও অনেকটা কমে আসবে। দেশবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেল যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে আনবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
রাজধানী ঢাকায় নির্মাণাধীন শহরভিত্তিক রেল ব্যবস্থা হচ্ছে ঢাকা মেট্রো যা আনুষ্ঠানিকভাবে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট বা সংক্ষেপে এমআরটি নামে পরিচিত। ২০১৩ সালে অতি জনবহুল ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও পথের দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় যার অধীনে প্রথমবারের মত ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে প্রণীত সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা অনুসারে ঢাকায় নির্মিতব্য মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি করা হয়। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন ৬-কে নির্বাচন করা হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুন এমআরটি-৬ প্রকল্পের নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে শুরু হয় ঢাকা মেট্রোর নির্মাণকাজের শুভ সূচনা। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য এমআরটি-৬ নামক ২০.১ কিলোমিটার দীর্ঘ পথকে নির্ধারণ করা হয়। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে জাইকা অর্থায়ন করে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে দেয় ৫ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে দু'দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে। জানা গেছে, ইতিমধ্যে মানুষের আশা আকাঙক্ষার প্রতীক মেট্রোরেলে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কিলোমিটার ৫ টাকা আর সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা। এমআরটি-৬ রুটে ১৬টি স্টেশন থাকবে। সেগুলো হলো- উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, মতিঝিল ও কমলাপুর। দুটি স্টেশনের মধ্যে গড় দূরত্ব হবে ১ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার। বেশি স্টেশন রাখার ফলে বিপুলসংখ্যক যাত্রী এর সুফল ভোগ করবে। ওপরে এবং নিচ থেকে লিফট বা চলন্ত সিঁড়ির মাধ্যমে যাত্রীদের ওপরে যাওয়ার ব্যবস্থাও থাকবে। ট্রেন চালানোর জন্য ঘণ্টায় দরকার হবে ১৩.৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যা নেওয়া হবে জাতীয় গ্রিড থেকে। এর জন্য বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
মেট্রোরেল চলাচলে আশপাশে যে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি হয় নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মেট্রোরেলের লাইনের নিচে এমএসএস (ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম) রয়েছে। ম্যাস স্প্রিং সিস্টেমে বিশেষ ধরণের বিয়ারিং থাকে, যার কাজ হলো রেললাইনে যে কম্পন তৈরি হয় তা শোষণ করা। এর ফলে ট্রেন চলাচলের সময় আশপাশে তেমন একটা কম্পন অনুভূত হবে না। মেট্রোরেল বিদ্যুৎচালিত। ভিভিভিএফ (ভেরিয়েবল ভোল্টেজ ভেরিয়েবল ফ্রিকোয়েন্সি) ইনভার্টার সিস্টেমে চালিত ট্রেন চলার সময় অনেক কম শব্দ তৈরি করে, যা শব্দদূষণের পর্যায়েও পড়ে না। আবার মেট্রোরেল প্রকল্পটি চালু হলে ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাস ব্যবহারকারী অনেক যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করবে। এর ফলে বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ অনেক কমবে। অন্যদিকে মেট্রোরেল যেহেতু বিদ্যুৎচালিত তাই বায়ুতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ নেই বললেই চলে। তাই মেট্রোরেল পরিবহন ব্যবস্থার চাইতে অবশ্যই পরিবেশবান্ধব।জানা গেছে, মেট্রোরেলের চালকের পদটির নাম ‘ট্রেন অপারেটর’। এই পদে ২৫ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। স্টেশন থেকে ট্রেন পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় করবেন স্টেশন কন্ট্রোলার। এই পদে ৩৪ জন নিয়োগ পেয়েছেন। তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে।
মেট্রোরেলে যাত্রী সাধারণের চলাচলে যে ১৪টি বিধি নিষেধ রয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ধূপপান না করা, পান না খাওয়া, কোনো ধরণের পণ্য ফেরী না করা, নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ও থুথু ফেলা, পোষা প্রাণী বহন না করা, একাধিক আসন দখল করে না বসা, মহিলাদের কোচে পুরুষ যাত্রী না ওঠা, বয়স্ক ও বিশেষচাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের সিটে অন্য যাত্রীদের না বসা, ভিক্ষাবৃত্তি না করা, মাঝখানের চলাচলের পথে দাঁড়িয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করা উল্লেখযোগ্য। সুষ্ঠু সুন্দর পরিবেশে আরামদায়ক যাতায়াত নিশ্চিত করতে এই বিধি নিষেধগুলো আমাদের সকলেরই মেনে চলা উচিত।
এছাড়াও ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর এমআরটি-১ এবং এমআরটি-৫ নামক লাইন দু'টির নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। এমআরটি-১ প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর ও নতুনবাজার থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত মোট ৩১.২৪ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল নির্মিত হবে। এ প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকার দেবে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা, বাকি ১৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা আসবে সরকারি তহবিল থেকে। এমআরটি-১ প্রকল্পে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ২১ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে এবং কুড়িল থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে। নতুন বাজার থেকে কুড়িল পর্যন্ত ৩ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রানজিশন লাইনসহ ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এই মেট্রোরেলের ১২টি স্টেশন থাকবে মাটির নিচে এবং ৭টি থাকবে উড়াল সেতুর ওপর। এমআরটি-৫ নির্মাণ প্রকল্পে হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ করা হবে। এই প্রকল্পের ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ২৯ হাজার ১১৭ কোটি টাকা দেবে জাপান আর বাকি ১২ হাজার ১২১ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পের মোট ২০ কিলোমিটারের মধ্যে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার হবে পাতাল পথে আর বাকি সাড়ে ৬ কিলোমিটার হবে উড়াল পথে। এ রুটে মোট ১৪টি স্টেশন হবে, যার মধ্যে ৯টি হবে পাতাল আর ৫টি হবে উড়ালপথে।
পরিশেষে বলবো বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করেছেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ অনেক আগেই বিশ্বের বুকে উন্নত দেশে পরিণত হত। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যার পরে বাঙালি জাতির সব চাইতে দুঃসময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরেন মানবতার নেত্রী বাঙালি জাতির কান্ডারি ঘোর অমানিশার মাঝে আলোর দিশারী জননেত্রী শেখ হাসিনা। নিজের অসীম শোককে শক্তিকে পরিণত করে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নিজের জীবন উৎসর্র্গ করেন। তিনি কখনো রাজপথে, কখনো সংসদে, কখনো সরকারে থেকে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, নিরলস প্রচেষ্টা, অক্লান্ত পরিশ্রম, জনগণ ও দেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, সততা, নিষ্ঠা, দক্ষতা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণেই বাংলাদেশ আজ বিশ^ দরবারে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। একের পর এক বিস্ময়কার সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কৃষি, খাদ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, যোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি সব ক্ষেত্রেই রয়েছে বড় বড় অর্জন। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশ পথ হারাবে না। উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার কোনো বিকল্প নাই। আগামী দিনেও যাতে এই ধারা অব্যাহত থাকে সে লক্ষ্যে এখন থেকেই আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে হবে। মেট্রোরেলের যাত্রা শুভ হোক। সকল মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন হোক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শতায়ু লাভ করুন এবং তাঁর নেতৃত্ব ও সু দক্ষ পরিচালনায় এগিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
লেখক: কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও চেয়ারম্যান, বক্ষব্যধি বিভাগ।