নারী নির্যাতন, লিঙ্গ বৈষম্য,
বাল্যবিবাহ ও স্বাস্থ্যসেবার সংকট এবং কর্মে প্রবেশ, নিরাপত্তা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের
মতো অধিকার প্রতিষ্ঠার অভাব থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে নারীর উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো।
এই অগ্রগতি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রশংসিত হচ্ছে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের
শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে,
যা ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিগুণ। এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় আশা দেখাচ্ছে। দেশের রাজনীতি,
সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, শিক্ষা, খেলাধুলা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সর্বক্ষেত্রে নারীরা
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করছে। দিন দিন তাদের সংখ্যা বাড়ছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে,
নারীর উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্য দুরীকরণে এখন নজর দেওয়ার সময় এসেছে।
বাংলাদেশে নারীর এই অগ্রগতির মধ্যেই শুক্রবার
(০৮ মার্চ) পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে
নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘নারীর সমঅধিকার,
সমসুযোগ, এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’। আজ রাজধানীর
ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে নারী দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান
অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। দিবসটি উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে মহিলা ও
শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
বিশ্বব্যাংকের মতে, যেসব দেশে শ্রমশক্তিতে
নারীর অংশগ্রহণের হার বেশি হয়, সেসব দেশের অর্থনীতির আরও শক্তিশালী হওয়ার প্রবণতায়
থাকে। এর কারণ হলো যখন নারীদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রদান করা
হয়, তখন তারা অর্থনীতিতে অবদান সম্পূর্ণভাবে রাখতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে
উৎপাদনশীলতা, উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতাকে ত্বরান্বিত করে। ফলে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ
বৃদ্ধি একটি দেশের জিডিপিতে উল্লেখযোগ্যভাবে ভূমিক রাখে।
বাংলাদেশের শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ বলছে,
দেশের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার এখন ৪৩ শতাংশ। ২০০৬ সালের জরিপে এ হার ছিল
২৯ শতাংশ এবং ২০১৭ সালের জরিপে এ হার ছিল ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত ১৬ বছরে এ হার
১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অথচ ভারতে এই হার মাত্র ২০ শতাংশ আর
পাকিস্তানে ২২ শতাংশ।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস
তৈরি পোশাক খাতের যে চল্লিশ লাখের অধিক শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে, তার ৮০ শতাংশের বেশি
নারী। ২০২২ সালে উচ্চশিক্ষায় (টারশিয়ারি) নারীদের ভর্তির হার ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রীদের ভাগ ৪৫ দশমিক শূন্য ৩ (২০২২) শতাংশ। এছাড়া প্রাথমিকে
ছাত্রীসংখ্যা ১০৪-এর বিপরীতে ছাত্রসংখ্যা ১০০ এবং মাধ্যমিকে ১১৪ ছাত্রীসংখ্যার বিপরীতে
ছাত্র ১০০। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের অনুপাত সরকারি ক্ষেত্রে ৬৪ দশমিক ৪১
শতাংশ এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে ৬৬ দশমিক ০৩ শতাংশ। মনে করা হয়, বাংলাদেশে নারী ক্ষমতায়নে
নারী শিক্ষার প্রসার বড় ভূমিকা রেখেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা ও কর্মসূচির
বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে সরকারের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি
পরিকল্পনা কৌশলে নারী উন্নয়নের বিষয়কে মূল ধারায় নিয়ে আসা হয়েছে।
দেশে নারীর উন্নয়নে গত তিন দশকে সরকার
বিশাল ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ক্ষমতায়ন বৃদ্ধিতে গুরুত্ব বিবেচনা
করে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। এর মধ্যে ৯০ দশকে শুরু হওয়া প্রাথমিকে উপবৃত্তি
চালুর পর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের উপবৃত্তি চালু করা হয়। নারী শিক্ষকদের জন্য
প্রণোদনা উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি। বর্তমান সরকার টানা কয়েক মেয়াদে নারীদের স্বাস্থ্যের
উন্নতির জন্য নারী-স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, বিনামূল্যে মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা প্রদান
এবং গর্ভনিরোধক ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা বিতরণ বিস্তৃত করেছে। এ ছাড়া নারীদের কর্মসংস্থানের
উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে শুধু নারীদের জন্য শিল্পপার্ক
স্থাপন এবং নারীদের জন্য বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান। জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত
আসন বাড়িয়ে রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। নারী উদ্যোক্তাদের উন্নীত করার
জন্য তহবিল প্রতিষ্ঠা, তাদের জন্য ঋণ ও প্রশিক্ষণ প্রদান এবং নারী-নেতৃত্বাধীন ক্ষুদ্র
ও মাঝারি আকারের উদ্যোগের উন্নয়নসহ বেশ কিছু উদ্যোগ চালু করেছে। নারীদের অধিকার রক্ষার
জন্য বেশ কিছু আইনি সংস্কার করেছে, যার মধ্যে রয়েছে গার্হস্থ্য সহিংসতা, যৌন হয়রানি
এবং অ্যাসিড হামলা প্রতিরোধে আইন প্রবর্তন। নারীর প্রতি সহিংসতা-সংক্রান্ত মামলার দ্রুত
বিচারের জন্য সরকার একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালও গঠন করেছে।
এ বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী
সিমিন হোসেন (রিমি) সম্প্রতি সচিবালয়ে তার কার্যালয়ে বলেন, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ও
উন্নয়ন অনেক এগিয়েছে। স্কুলে মেয়েদের ভর্তির হার বেড়েছে এবং ঝরে পড়ার হার কমেছে।
উচ্চ শিক্ষায়ও মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, রাজনীতি ও প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং
বেসরকারি চাকরি- সব ক্ষেত্রেই নারীরা এগিয়েছে।
নারীর উন্নয়ন বাংলাদেশের অগ্রগতির বিষয়ে
জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, আমরা সাধারণত নারীর
উন্নয়ন ও বৈষম্যকে এক করে ফেলি। তবে মনে রাখতে হবে, নারীর উন্নয়ন হলেই সব ঠিক হয়ে
গেল না। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে নারীর বৈষম্য রয়েছে কোন কোন জায়গায়। এগুলো নিয়ে
গবেষণা করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা দরকার।
প্রসঙ্গত, ১৯১৪ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে
নারী দিবস পালন শুরু হয়। ১৯৭৫ সালে দিনটিকে নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ।
নারী দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হলো নারী ও পুরুষের সমঅধিকার আদায়। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন
অঞ্চলে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাদের কাজের প্রশংসা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক
নারী দিবসকে মহিলাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য অর্জনের উৎসব হিসেবেই পালন
করা হয়।