আবারও একটি বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই দীর্ঘায়িত হতে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গোটা বিশ্বে যে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তার প্রভাবেই এই মন্দার আশঙ্কা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সম্ভাব্য এই মন্দার পূর্বাভাস দিয়েছে। ২০২৩ সালের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ে মন্দা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিভিন্ন সংস্থা।
এ নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় রয়েছেন বিশ্বনেতারা। বিভিন্ন দেশ নিচ্ছে আগাম প্রস্তুতি। বাংলাদেশও বসে নেই। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভাব্য মন্দার প্রভাবে আগামী বছর দেশের অর্থনীতিতে চাপ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বলেছেন প্রস্তুতির কথাও। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের মানুষকে তিনি প্রতি ইঞ্চি জমিতে শস্য আবাদের পরামর্শ দিয়েছেন। যাতে করে উৎপাদন বাড়িয়ে মানুষ সঞ্চয় করতে পারে। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি না হয়। অপচয় বন্ধ করতে সরকারি সংস্থাগুলো নির্দেশনা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী অর্থবছরের বাজেট কেমন হবে, তা নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা করার কথা জানিয়েছেন।
সরকার কতটা প্রস্তুত এ বিষয়ে খোঁজ নিলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মন্দা দেখা দিলে বাংলাদেশও তার বাইরে থাকবে না। তবে বাংলাদেশ কতটা চাপে পড়বে, তা নির্ভর করছে মন্দার ব্যাপকতার ওপর। সঠিক পদক্ষেপ নিলে সংকট এড়ানো সম্ভব। তবে আগামী কিছুদিন যে বিশ্ব অর্থনীতি ভালো যাবে না, তা বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস থেকে নিশ্চিত। এজন্য সরকার বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ঠিক রাখা। বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন, যাতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। সেবা ও ভোগ চাহিদা ধরে রাখা। কর্মসংস্থান ও সঞ্চয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখাও সরকারের লক্ষ্য। মন্দার আশঙ্কা যেহেতু আগামী বছর, তাই আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ বিষয়ে কৌশলগত উদ্যোগ ও বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বেসরকারি আর্থিক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিশ্বমন্দার প্রভাবে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের আমদানি পণ্যের দামে অস্থিরতা আরও বাড়বে। ডলারে সংকট আরও প্রকট হবে। এটি ধাক্কা দেবে রিজার্ভের ওপর। কমবে রেমিট্যান্স, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। বাড়বে মূল্যস্ফীতি। এসব মোকাবিলা করে অর্থনীতিকে সচল রাখাই হবে সরকারের কার্যকর প্রস্তুতি। তবে এই প্রস্তুতির জন্য দরকার সরকারের ব্যয় বাড়ানো। কিন্তু রাজস্ব আয় কমছে। সম্ভাব্য মন্দায় এটা আরও কমবে। আবার যেহেতু বিশ্বমন্দা। দাতাদের কাছে প্রায় সব দেশই ঋণ চাইবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওই অস্থির পরিস্থিতিতে কতটা ব্যয় বাড়াতে পারবে, সেটি নিয়ে সংশয় তো থাকছেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ২০০৭-০৮ সালেও সফলভাবে বিশ্বমন্দা মোকাবিলা করেছে। করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছে। সম্ভাব্য মন্দাও সফলভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে। তবে সরকার যদি সতর্কভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় তাহলে অর্থনীতি আবারও পিছিয়ে যাবে।
এদিকে বর্তমানে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে রয়েছে তার হালনাগাদ পরিস্থিতি জানতে আগামী নভেম্বরে বসছে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে আর্থিক বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠক। ওই বৈঠকেই চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের ব্যয়সংকোচনের বাজেট মূল্যায়নের পাশাপাশি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটেরও রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, মন্দা দেখা দিলে সরকার তার প্রভাব মোকাবিলায় একটি বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। দেশের অর্থনীতিতে করোনা মহামারির প্রভাব মোকাবিলায় সরকার ২৮টি প্যাকেজ নিয়েছে। আগামীতে প্রয়োজন হলে একই ধরনের প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারে সরকার। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত সুরক্ষিত রাখতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়াতে সরকার রেমিট্যান্সের বিপরীতে প্রণোদনার হার বাড়াতে পারে। বর্তমানে রেমিট্যান্সে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।
এর আগে করোনা মহামারির প্রভাব মোকাবিলায় ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় সরকার। এর মধ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ। চলতি বছরের বাজেটে এই নতুন চ্যালেঞ্জ ও করোনার প্রভাব মোকাবিলার উদ্যোগ অব্যাহত আছে। এখন আসন্ন মন্দার শঙ্কায় আগামী বাজেটেও অনুৎপাদনশীল প্রায় সব খাতে অপ্রত্যাশিত ব্যয় কমিয়ে তা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার।
বিশ্বমন্দায় দেশে দেশে যা ঘটতে পারে : বৈশ্বিক মন্দা দেখা দিলে জ্বালানির বর্তমান সংকট আরও তীব্র হতে পারে। বাড়তে পারে দামও। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাড়বে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে কমবে চাহিদা। এতে করে কমে যাবে রপ্তানি আয়ের ধারাবাহিকতা। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব পড়বে বিশ্বের বিভিন্ন খাতের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে। ফলে কমতে পারে রেমিট্যান্স। বৈশ্বিকভাবে মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা আরও বাড়তে পারে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান সঞ্চিত রিজার্ভ আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে কমে যায়। শিল্পোৎপাদন হ্রাস পায় এবং ব্যাংকে ব্যাংকে নতুন খেলাপি উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়। এসবের প্রভাবে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে আসে এবং বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়। সার্বিকভাবে মোট দেশজ উৎপাদনও (জিডিপি) কমে যেতে পারে দেশে দেশে।
প্রভাব মোকাবিলায় সরকারের পরিকল্পনা : মন্দার কারণে বাড়বে আমদানি পণ্যের দাম। আমদানি খরচ কমাতে সরকার সব খাতেই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। বিশেষ করে কৃষি ও উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এজন্য প্রয়োজনে বাড়তি ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেওয়া হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি প্রণোদনা বাবদ মোট বরাদ্দের ১৭ দশমিক ২ শতাংশ ব্যয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী বাজেটে এ বরাদ্দ আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সেজন্য উন্নয়ন ব্যয় ছোট করা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বাজেটের ৫ দশমিক ৮ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ রয়েছে। আগামী বাজেটে তা সাড়ে ৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় জ্বালানি তেলের পরিবর্তে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে সৌর বিদ্যুতেও উৎসাহ দেওয়া হবে। এ ছাড়া টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে যে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে, আগামীতে তার সুবিধাভোগী বাড়ানো হতে পারে।