সৃষ্টির সূচনাকাল
থেকেই মুহররম মাস এক বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। হিজরি বা আরবি বছরের প্রথম
মাস মুহররম। অনেকের ধারণা কারবালায় নির্মম ঘটনার কারণেই ইসলামি শরিয়তে আশুরার এত গুরুত্ব।
অথচ এ ধারণা ঠিক নয়। কেননা কারবালার ঘটনার বহুকাল পূর্বে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা আশুরার
দিনে সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এ তারিখটি মুসলিম বিশ্বের কাছে গভীর শোকের দিন হিসেবে বরিত
হয়ে আসছে।
এই দিনে বিশ্বনবী
ও শ্রেষ্ঠনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়
ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে কারবালার
প্রান্তরে শাহাদত বরণ করেন। তাই ঐতিহাসিকভাবেই এ দিনটির গুরুত্ব অনেক। এছাড়া আশুরায়
রোজা রাখার নির্দেশ আমরা মহানবীর (সা.) জীবনাদর্শ থেকে পেয়ে থাকি।
মানব ইতিহাসের
নানা তাৎপর্যময় ঘটনার সাক্ষী এই মাস। ইসলামপূর্ব আরবের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজেও মুহররম
মাসের বিশেষ মর্যাদা ছিল। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত পবিত্র চার মাসের অন্যতম মুহররম। ইরশাদ
হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মাসগুলোর গণনা আল্লাহর কাছে বারো
মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে
চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোতে নিজদের ওপর কোনো
জুলুম করো না।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬)
উল্লিখিত আয়াতে
আল্লাহর বাণী ‘তোমরা এতে নিজেদের
ওপর কোনো জুলুম কোরো না’ বাক্যটি প্রমাণ করে এ সময়ে সংঘটিত অন্যায় ও অপরাধের পাপ অন্যান্য
সময়ের চেয়ে বেশি ও মারাত্মক। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ‘তোমরা এতে নিজেদের ওপর কোনো জুলুম কোরো
না’-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, এ বারো মাসের কোনোটিতেই তোমরা অন্যায় অপরাধে জড়িত হয়ো না।
অতঃপর তা হতে চারটি মাসকে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করেছেন। এসব মাসে সংঘটিত অপরাধকে অতি
মারাত্মক বলে গণ্য করেছেন। আর তাতে সম্পাদিত নেক আমলকে বেশি সওয়াবযোগ্য নেক আমল বলে
সাব্যস্ত করেছেন। কাতাদা (রা.) বলেছেন, যদিও অন্যায়-অবিচার সব সময়ের জন্য বড় অন্যায়,
তবে হারাম মাস চতুষ্টয়ে সম্পাদিত জুলুম অন্যান্য সময়ে সম্পাদিত জুলুম হতে অপরাধ ও পাপের
দিক থেকে আরো বেশি মারাত্মক অন্যায়। আল্লাহ তায়ালা নিজ ইচ্ছামাফিক যাকে ইচ্ছা বড় করতে
পারেন।
ইতিহাসের বাঁকে
বাঁকে আশুরা:
মুহররম মাসের
১০ তারিখ আশুরা নামে খ্যাত। এই আশুরাতেই নভোমণ্ডলে সৃষ্টিকুলের প্রাথমিক বিভাজনপ্রক্রিয়ার
সূচনা হয়। হজরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টি, স্থিতি, উত্থান ও অবনমন—সব ঘটনাই ঘটেছিল আশুরায়।
হজরত নুহ (আ.)-এর নৌযানের যাত্রারম্ভ ও বন্যাবস্থার সমাপ্তি ছিল আশুরাকেন্দ্রিক। হজরত
মুসা (আ.) এর সমুদ্রপথের ধাবমান রওনা ও এর তাওয়াক্কুল যাত্রায় যে সময় বেছে নেয়া হয়েছিল,
তা ছিল আশুরা। এ ধারাবাহিকতায় আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.) কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার
সমূহ সম্ভাবনার কথা আশুরার সময়ে বা আশুরাকেন্দ্রিক হতে পারে বলে আশা ও আশঙ্কা ব্যক্ত
করেছেন। এ সময় এলেই তিনি বিনম্র থাকতেন, রোজা রাখতেন। (তাফসিরে তাবারি, ইবনে জারির)।
কোরআন কারিমে রয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবী
সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা বারো, তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’
(সুরা-৯, তাওবা, আয়াত: ৩৬)। হাদিস শরিফে মুহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর পবিত্র কোরআনে
উল্লেখিত সুরা তাওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে ‘অতি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ চার মাস’ বলতে জ্বিলকদ, জ্বিলহজ,
মুহররম ও রজব—এই চার মাসকে বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি)।
যেভাবে শুরু আশুরার
রোজা:
আবদুল্লাহ ইবনে
আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) মদিনায়
এসে দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবী (সা.) বললেন, এটি কী? তারা
বলল, এটি একটি ভালো দিন। এ দিনে আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর কবল থেকে
বাঁচিয়েছেন। তাই মুসা (আ.) রোজা পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-কে
অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। অতঃপর তিনি রোজা রেখেছেন এবং সাওম
রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৬৫)
মুসনাদে আহমাদের
বর্ণনায় এসেছে ‘এটি সেই দিন যেদিন
নুহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পর্বতে স্থির হয়েছিল, তাই নুহ (আ.) আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায়ের
জন্য সেদিন রোজা রেখেছিলেন।’ (হাদিস : ৮৭১৭) আশুরার রোজার প্রচলন ইসলাম আগমনের আগেও
জাহেলি সমাজে প্রচলিত ছিল। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ‘জাহেলি যুগের লোকেরা আশুরার রোজ সাওম পালন
করত।’ (তুহফাতুল আশরাফ, হাদিস : ১২৭৩৬)
আশুরার রোজার
মর্যাদা:
আবদুল্লাহ ইবনে
আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘আমি নবী (সা.)-কে
রোজা রাখার এত বেশি আগ্রহী হতে দেখিনি, যত দেখেছি এ আশুরার দিন এবং এ মাস (রমজান) মাসের
রোজার প্রতি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৬৭) রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিনের সাওমের ব্যাপারে আমি আল্লাহর
কাছে আশা করি, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস
: ১৯৭৬)
আশুরার রোজা কীভাবে
রাখব:
আবদুল্লাহ ইবনে
আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ‘যখন রাসূলুল্লাহ
(সা.) আশুরার রোজা রাখলেন এবং (অন্যদেরকে) সাওম রাখার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা বলল, হে
আল্লাহর রাসূল! এটি তো এমন দিন, যাকে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা বড় জ্ঞান করে, সম্মান জানায়।
তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আগামী বছর এই দিন এলে আমরা নবম দিনও রোজা রাখব ইনশাআল্লাহ।’
(সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৪৬)
ইমাম শাফি, ইমাম
আহমাদ, ইমাম ইসহাক প্রমুখ বলেছেন, আশুরার রোজার ক্ষেত্রে দশম ও নবম উভয় দিনের রোজাই
মুস্তাহাব। কেননা নবী (সা.) ১০ তারিখ রোজা রেখেছেন আর ৯ তারিখ রোজা রাখার নিয়ত করেছেন।
আশুরার রোজার
স্তর:
আলোচ্য হাদিসের
আলোকে আশুরার রোজার কয়েকটি স্তর রয়েছে : সর্বনিম্ন হচ্ছে কেবল ১০ তারিখের রোজা রাখা।
এর চেয়ে উচ্চ পর্যায় হচ্ছে তার সঙ্গে ৯ তারিখের সাওম পালন করা। এমনিভাবে মুহররম মাসের
রোজার সংখ্যা যত বেশি হবে মর্যাদাও ততই বাড়তে থাকবে।
মুহররম মাসের
নফল রোজা কয়টি?
আবু হুরায়রা
(রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজানের পর সর্বোত্তম সাওম হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহররম (মাসের
সাওম)।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৮২) আল্লামা মোল্লা আলী কারি (রহ.) বলেন, হাদিসের
বাহ্যিক শব্দমালা থেকে পূর্ণ মাসের সাওম বুঝে আসে। তবে নবী (সা.) রমজান ছাড়া আর কোনো
মাসে পূর্ণমাস সাওম পালন করেননি, এটি প্রমাণিত। তাই হাদিসকে এই মাসে বেশি পরিমাণে রোজা
পালন করার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে বলে ধরা হবে।
শুধু ১০ তারিখ
রোজা রাখা কি পাপ?
শায়খুল ইসলাম
ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, আশুরার রোজা এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা আর আশুরার একটি রোজা
রাখা মাকরুহ হবে না। আল্লামা ইবন হাজার হায়সামি রচিত তুহফাতুল মুহতাজ গ্রন্থে আছে,
আশুরা উপলক্ষে ১০ তারিখ কেবল একটি রোজা রাখাতে কোনো দোষ নেই।
আশুরার দিনে অন্য
আমল:
হজরত আবু হুরায়রা
(রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে আপন পরিবার-পরিজনের
মধ্যে পর্যাপ্ত খানাপিনার ব্যবস্থা করবে, আল্লাহপাক পুরো বছর তার রিজিকে বরকত দান করবেন।
-তাবরানি: ৯৩০৩
উল্লিখিত হাদিস
সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল জাওযিসহ অনেক মুহাদ্দিস আপত্তিজনক মন্তব্য করলেও বিভিন্ন সাহাবি
থেকে ওই হাদিসটি বর্ণিত হওয়ায় আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতিসহ অনেক মুহাক্কিক আলেম হাদিসটিকে
গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। -জামিউস সগির: ১০১
আশুরায় প্রচলিত
কিছু বিদআত:
আশুরার দিন লোকেরা
সুরমা লাগানো, গোসল করা, মেহেদি লাগানো, মুসাফাহা করা, খিচুড়ি রান্না করা, আনন্দ উৎসবসহ
বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে থাকে। এ সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া (রহ.)-কে
প্রশ্ন করা হলো, এর কোনো ভিত্তি আছে কি না? উত্তরে তিনি বললেন, এসব অনুষ্ঠানাদি উদ্যাপন
প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে সহিহ কোনো হাদিস বর্ণিত হয়নি এবং সাহাবিদের থেকেও
না। চার ইমামসহ নির্ভরযোগ্য কোনো আলেমও এসব কাজকে সমর্থন করেননি। কোনো মুহাদ্দিস এই
ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ ও সাহাবিদের থেকে কোনো সহিহ কিংবা দুর্বল হাদিসও বর্ণনা করেননি।