চলতি ২০২৪ সাল
যেন একেবারেই ভালো কাটছে না দেশের পর্যটন খাতের। বছরের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনপরবর্তী
উত্তপ্ত পরিস্থিতি, এরপর দীর্ঘমেয়াদি তাপপ্রবাহ, এমনকি দুই ঈদুৎসবের সময়ও মন্দার মুখে
ছিলো এ খাত। তার ওপর জুলাই ও আগস্টজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে
দেশের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় ভয়াবহ বন্যায় আরও বিপর্যয় নেমে এসেছে খাতটিতে। জনপ্রিয় বিনোদন
কেন্দ্রগুলো ফাঁকা বললেই চলে; নেই ভ্রমণপিপাসুদের কোলাহল। এতে হুমকির মুখে পড়েছে এ
খাতকে ঘিরে অন্তত ১৬ ধরনের পরিষেবা দেয়া লোকজনের জীবিকা।
জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার
আন্দোলন দমন করতে বিগত সরকারের নেয়া ইন্টারনেট শাটডাউনের পদক্ষেপেই ট্যুরিজম খাতে প্রায়
এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতির স্বীকার হতে হয়েছে বলে জানিয়েছে খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর বেশকিছুদিন দেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি হওয়া অনিশ্চয়তার
প্রভাবও পড়ে পর্যটন খাতে। এরপর আসে বন্যা। বৃহত্তর সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপ্রিয়
বেশ কিছু পর্যটন স্পটেও পড়ে বন্যার প্রভাব।
এ খাতের ব্যবসায়ী
ও সেবাদানকারীরা বলছেন, ভ্রমণের জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল পরিবেশ। এতদিন সেই পরিবেশটাই
ছিলো না। কিন্তু এখন যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তাই তাদের
প্রত্যাশা, অচিরেই দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার মাধ্যমে সুদিন ফিরবে পর্যটন খাতে। তবে
এর জন্য এই খাতে সরকারের সর্বাত্মক সহযোগিতা চান খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও সেবাদানকারীরা।
এ ব্যাপারে ট্যুর
অপারেটরস এসোসিয়েশনস অব বাংলাদেশ (টোয়াব)-এর ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট রিলেটেড স্টিয়ারিং
কমিটির চেয়ারম্যান ও কেয়ার ট্যুরিজমের প্রোপাইটার মো. সোরওয়ার্দি হোসেন সারওয়ার বলেন,
‘এবার পর্যটনের
মৌসুম এমনিতেই ছিলো মন্দার মধ্যে; তবে এর ভেতরেও টাঙ্গুয়ার হাওড়, সাজেক, খাগড়াছড়ি,
রাঙ্গামাটি, বান্দরবানসহ হাওর এলাকাগুলোতে বর্ষার সময় পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। কিন্তু
সাম্প্রতিক আন্দোলন এবং তার পরের এই বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখন সেই
ব্যবসাটাও নেই। বিশেষ করে বর্ষার সময় সিলেটসহ পার্বত্য অঞ্চলের ঝরনাগুলোর প্রতি পর্যটকদের
আকর্ষণ থাকে।
‘কিন্তু বন্যা ও রাজনৈতিক কারণে বর্তমানে
সেসব এলাকায় পর্যটকরা যাচ্ছেন না। আগে যেখানে এই সময় টাঙ্গুয়ার হাওড়ে পর্যটকদের ঢল
নামতো, এখন সেখানে পর্যটক নেমে এসেছে তিন ভাগের একভাগে। আর পাহাড়েও কেউ যাচ্ছেই না
বন্যার কারণে। এটা দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটনের অবস্থা। আবার আগে ভারতে যে বাংলাদেশি
পর্যটকরা যেতেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেটাও কমে গেছে। ফলে এ পর্যটকদের ভিসা ও
অন্যান্য সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে যেসব ট্যুর অপারেটর কাজ করতেন তারাও বর্তমানে প্রায়
কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
‘এই পরিস্থিতির সঙ্গে আছে চলতি বছরের বাজেটে
আমাদের ওপর আরোপ করা ১৫ শতাংশ ভ্যাট, যা অনেকটাই মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো। আমরা পর্যটকদের
যেসব সেবা দিই, সেখানে বাসের টিকিট থেকে শুরু করে হোটেলের রুম ভাড়া, এমনকি খাবারের
ওপরও নির্ধারিত ভ্যাট দিই। এরপর হয়তো আমরা সামান্য লাভ করি, সব মিলিয়ে যা ৫ শতাংশের
বেশি না। কিন্তু এখন যদি এর ওপরও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়, তবে অনেক ট্যুরিজম প্রতিষ্ঠানই
পথে বসবে। সরকারের প্রতি বিষয়টি ভেবে দেখার আহ্বান জানাই।’
বিগত সরকারের
কাছেও ভ্যাটের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছিলেন খাত সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু সরকার
সে সময় এ দাবি মানেনি। এখন তাদের প্রত্যাশা, গণ অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আসা অন্তর্বর্তীকালীন
সরকার যেন চাপিয়ে দেয়া এ ভ্যাট পুনর্বিবেচনা করে। টোয়াবের পক্ষ থেকেও সরকারের কাছে
এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানানো হবে বলে জানান মো. সোরওয়ার্দি হোসেন সারওয়ার।
রয়েল বেঙ্গল ট্যুরস-এর
পরিচালক ও টোয়াবের হিল ট্রাকস রিলেটেড স্টিয়ারিং কমিটির কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর
রহমান জুয়েল বলেন, ‘ট্যুরিজম খাতটা খুবেই স্পর্শকাতর, রাজনৈতিক
অস্থিরতা বলেন, আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলেন, সবার আগে বন্ধ হয় আমাদের এই খাত, আবার খোলেও
সবার পরে। বাংলাদেশের ট্যুরিজম খাতে দুধরনের পর্যটক রয়েছেন, যারা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে
আসেন তাদেরকে ইনবাউন্ড ট্যুরিস্ট বলা হয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ থেকে যারা বিদেশে ট্যুরিজমের
উদ্দেশ্যে যান তাদের আউটবাউন্ড ট্যুরিস্ট বলা হয়।
‘সাম্প্রতিক এই সঙ্কটগুলোতে সবচেয়ে বেশি
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইনবাউন্ড ট্যুরিজম। কারণ দেশের এ পরিস্থিতিতে বিদেশি পর্যটকরা দেশের
বাইরে থেকে বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ইচ্ছে থাকলেও আসার সাহস পাচ্ছেন
না। আমার জানামতে বাংলাদেশের যতগুলো ইনবাউন্ড ট্যুর অপারেটর ব্যবসা করছেন, তাদের ডিসেম্বর
পর্যন্ত যত ট্যুর হওয়ার কথা ছিলো তার বেশিরভাগই ক্যানসেল হয়ে গেছে। পাশাপাশি পাহাড়ি
এলাকায় তো নিরাপত্তার সমস্যা কারণে এই পরিস্থিতির আগে থেকেই বিরাজ করছে।’
এসবের পাশাপাশি
সরকারি কিছু নিয়ম-কানুনও পর্যটন ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে বলে উল্লেখ
করেন মোস্তাফিজুর রহমান জুয়েল। তিনি বলেন, ‘সরকার পোশাক রফতানিকারকদের
প্রণোদনা দিচ্ছে, কারণ তারা বিদেশ থেকে ডলার আনছেন। একই ভাবে পর্যটন ব্যবসায়ীরাও বিদেশি
পর্যটকদের দেশে আনার মাধ্যমে ডলার আনছেন। গার্মেন্টসের থেকে আয় হওয়া ডলারের একটি বড়
অংশ আবার কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি বাবদ বিদেশেই চলে যায়। কিন্তু বিদেশি পর্যটকরা এসে
যেসব ডলার খরচ করেন, দেশেই থেকে যাচ্ছে তার প্রায় পুরোটা।’
শ্রীলঙ্কার উদাহরণ
টেনে তিনি বলেন, ‘দেশটি কিছুদিন আগেও বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে
না পেরে দেউলিয়া হয়ে পড়েছিলো। আবার মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণভাবে
তাদের ট্যুরিজমের ওপর ভর করে। শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশেরও ট্যুরিজম খাতে ব্যাপক সম্ভাবনা
রয়েছে।’
টোয়াবের কমিউনিটি
বেসড ট্যুরিজম স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও স্পিড হলিডেস-এর প্রধান নির্বাহী মেসবাউল আলম
বলেন, ‘কোভিডের সময় পর্যটন
খাতে যে ধাক্কা লাগে সারা বিশ্বের সঙ্গে তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে। সেটা সামলে উঠে
যখন দেশের পর্যটন খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের
কারণে এই খাত প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। ট্যুর অপারেটররা কর্মচারীদের বেতন ও অফিস খরচ
চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে সরকারকে বিশ্ব দরবারে এই বার্তা দিতে হবে যে,
দেশে এখন আন্দোলন সংগ্রাম শেষ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি স্থিতিশীল। বিদেশিরা নির্ভয়ে বাংলাদেশে
ভ্রমণ করতে পারেন। এই বার্তাটি দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে। তাহলেই মানুষের
মধ্যে আস্থা তৈরি হবে, তারা বাংলাদেশ ভ্রমণে উৎসাহিত হবেন।’