
নার্সিসাস, নার্সিসিজম, নার্সিসিস্ট এই শব্দগুলোর সাথে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত । মূলত আত্মপ্রেম বা আত্মমগ্নতাই নার্সিসিজম এর বৈশিষ্ট্য । আজকাল অতিরিক্ত সেলফি রোগে আক্রান্ত লোক চোখে পড়ে প্রায় সবজায়গাতেই । এরাই নার্সিসিস্ট হিসেবে খ্যাত । আবার নার্সিসাস (Narcissus) বা নার্সিসিসি একটি ডেফোডিল জাতীয় ফুলের নাম । গ্রীক পুরাণ অনুসারে এই ফুলের জন্ম নার্সিসাস নামের একজন অপূর্ব সুন্দর যুবকের দেহ থেকে । আজকের পর্বে আলোচনা করা হবে গ্রিক মিথলজির নার্সিসাসের চমকপ্রদ কাহিনী নিয়ে ।
গ্রীক পুরাণের নদী দেবতা সিফিসাস এবং জলপরী লিরিউপির পুত্র নার্সিসাস । অপূর্ব সৌন্দর্যের অধিকারী নার্সিসাসের রূপের বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না । আর এই রূপ মাধূর্যই তাকে অহংকারী আর আত্মগর্বিত যুবকে পরিণত করে । যেকোন মেয়ে এমনি পরীরাও তাকে দেখামাত্রই তার প্রেমে পড়ে যেত । নার্সিসাসের জন্মের পর তার মা তাকে নিয়ে গেলেন এক অন্ধ ভবিষ্যৎ-বক্তা টাইরেসিয়াসের কাছে ছেলের আয়ুষ্কালের ব্যাপারে জানতে । জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার ছেলে কতদিন বাঁচবে?’ টাইরেসিয়াস বললেন, ‘এই ছেলে একটা লম্বা জীবন পাবে কেবল যদি সে নিজেকে কখনো না দেখে।’
কিন্তু ছোটবেলা থেকেই নিজের রূপের প্রশংসা শুনতে শুনতে অদ্ভূত অহংকার জাগে নার্সিসাসের মনে । সে শুধু নর নয় নারীদেরকেও তার তুলনায় রূপে নিকৃষ্ট ভাবা শুরু করে । কারও ভালোবাসায় সাড়া দিতেন না বরং প্রত্যেকেই হয়েছিলেন প্রত্যাখ্যাত ও তার নিষ্ঠুরতার শিকার । তিনি মনে করতেন তার যোগ্য ও সমকক্ষ কেউ নেই। তিনি যখন জানতে পারতেন কোন অপ্সরী তার প্রেমে পড়েছে তাহলে সেই অপ্সরীকে তিনি ঘৃণাভরে অভিশাপ দিতেন বা হত্যা করতেন । একবার এমিনিয়াস নামক এক যুবক নার্সিসাসের প্রেমে মজেছিল ভীষণ রকম। এই এমিনিয়াস তার আরও পুরুষ অনুরাগীদের ইতোমধ্যে ফিরিয়ে দিয়েছে শুধুমাত্র নার্সিসাসকে পাওয়ার জন্য। কিন্তু নার্সিসাস ফিরিয়ে দিল তাকে এবং একটা ছুরি উপহার দিল। এর পেছনে ছিল এক গোপন ষড়যন্ত্র। নার্সিসাসের গোপন ইচ্ছাও পূরণ হলো সেদিন, যেদিন এমিনিয়াস সেই ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করল নার্সিসাসেরই দরজার সামনে । মিথলজিতে নার্সিসাসের নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে বড় উদাহরন হিসেবে দেবী অপ্সরী ইকোর নামটি উল্লেখযোগ্য । ইকো ছিলেন অপূর্ব মিষ্টি কন্ঠস্বরের অধিকারী। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে হেরা দেবীর অভিশাপে অন্যের কথার প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া নিজে থেকে কোন কথা বলতে পারতো না ইকো । তিনি বাস করতেন গভীর জঙ্গলে ও পাহাড়ে । তার দুর্ভাগ্য আরো গাঢ়তর হয়ে গেল যখন সে নার্সিসাসের প্রেমে পড়লো ।
নার্সিসাস বনে যেত শিকার করার জন্য আর বনপরী ইকোও তাঁর অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকতো । সে নার্সিসাসের পেছনে পেছনে ঘোরে কিন্তু কথা বলতে পারে না তার সাথে । একদিন সুযোগ পেয়ে গেল সে । নার্সিসাস তার সঙ্গীদের ডাকছিল “কেউ এখানে আছে?” ইকো আনন্দিত স্বরে প্রতিধ্বনি করল শেষ শব্দটি, “আছে, আছে ।” গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ইকোকে নার্সিসাস ডাকলো “এসো”। ইকো আবারও উৎফুল্ল হয়ে জবাব দিল “এসো” । আর দুবাহু বাড়িয়ে বেরিয়ে এলো বন থেকে কারণ স্বয়ং নার্সিসাস তাকে ডেকেছে । কিন্তু অহংকারী নার্সিসাস বিরক্তিতে ফিরিয়ে নিলো তার মুখ । সে বললো, ‘’আমি বরং মারা যাবো কিন্তু তোমাকে কাছে আসতে দিব না ।” ইকো তার লজ্জা লুকানোর জন্য প্রবেশ করলো এর নির্জন গুহায় । তাকে সান্ত্বনা দেবার ক্ষমতা ছিল না কারো । ধীরে ধীরে বেদনা আর কাতরতায় তার শরীরও লীন হয়ে গেলো। শুধু রয়ে গেলো তার কন্ঠস্বর, যা অন্যের উচ্চারিত শব্দকে অনুকরণ করে ।
নার্সিসাস একইভাবে আরো অসংখ্য পরীকে আকৃষ্ট করে শেষে তাদেরকে তাচ্ছিল্যের সাথে দূরে সরিয়ে দিতো। এভাবে অপমানিত হয়ে তারা মন থেকে চাইত যে, ভালোবেসেও ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট কেমন তা নার্সিসাস একবার বুঝুক। এমন প্রত্যাখাতদের মধ্যে একজন একবার প্রতিশোধের দেবী নেমেসিসের কাছে প্রার্থনা করলো, “হে দেবী নেমেসিস, নার্সিসাস যদি কখনো প্রেমে পরেও, সে যেন ভালোবাসা না পায়”। নেমেসিস প্রার্থনা শুনেছিলেন এবং নার্সিসাসের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেললেন।