রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে বিশ্ববাজারে
জ্বালানির বাজার স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আছে। সাধারণ হিসাব-নিকাশের
বাইরে চলে গেছে জ্বালানির উচ্চমূল্য। এর ফলে কম অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশগুলো চরম বিপাকে
পড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ এখন চরম জ্বালানি সংকটে সময় পার করছে। গ্যাস সংকটে শিল্পকারখানাগুলো
ধুঁকছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশে আমদানিনির্ভর জ্বালানির ব্যবহার কমানো ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির
পরিমাণ বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হয়েছে সরকার। গত ১০ বছর ধরে সরকার জীবাশ্ম জ্বালানির পাশাপাশি
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করলেও নানা সীমাবদ্ধতায় কাক্সিক্ষত সাফল্য
আসেনি। এবার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এ প্রচেষ্টা জোরদার করতে চায় সরকার।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সরকারের
জ্বালানি পরিকল্পনার মধ্যে ছিল মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির।
গত ১০ বছরে এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোট বিদ্যুৎ
উৎপাদনের ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ আসে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে। ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ
উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন হয় মাত্র ৯৪১ দশমিক ৪২ মেগাওয়াট।
সেটাও নিয়মিত নয়।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ
উৎপাদনে আমাদের একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। সেটা হলো বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য
জ্বালানি থেকে উৎপাদন করা হবে। বিশেষ করে এখন বিশ্ব বাজারে আমদানিনির্ভর জ্বালানির
অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির গুরুত্ব আরও বেড়েছে। আমরা আমাদের
লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছি।’
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের
যাত্রা শুরু হয় অনেক আগে। ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীর ওপর দেশের
প্রথম পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রর যাত্রা
শুরু হয়। পরে ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে এই কেন্দ্রে ৫০ মেগাওয়াটের কাপলান টাইপের টার্বাইন
সংবলিত চতুর্থ ও পঞ্চম ইউনিট স্থাপন করা হয়, যাতে মোট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায়
২৩০ মেগাওয়াট। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটে প্রথম সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনে বেসরকারি
উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
পরবর্তী সময়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট
কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) কর্তৃক সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত
হয়। ১৯৯৬ সালে এসএইচএস চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য
জ্বালানি কর্মসূচি। ইডকলের মাধ্যমে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ মিলিয়ন সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন
করা হয়েছে। তবে কাপ্তাইয়ের ২৩০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া উল্লেখযোগ্যভাবে
বড় ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানির তেমন প্রকল্প তৈরি করা যায়নি। দীর্ঘ সময়েও কাঙ্খিত লক্ষ্য
বাস্তবায়ন হয়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের
বিভন্ন স্থানে এ পর্যন্ত ৯টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে
বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ২৬১ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ। এ প্রকল্পগুলোর মধ্যে তিনটি সরকারি পর্যায়ে
এবং ছয়টি বেসরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া সৌরবিদ্যুতের মধ্যে আরও আছে
সোলার হোম এবং ছাদে স্থাপিত রুফটপ সৌরবিদ্যুৎ প্রযুক্তির বিদ্যুৎ উৎপাদন। যার মোট উৎপাদন
ক্ষমতা ৩৬৫ মেগাওয়াট। এর মধ্যে নেট মিটারিং সিস্টেমে স্থাপিত ক্ষমতা ৪৫ দশমিক ৮০১ মেগাওয়াট।
সূত্র মতে, বায়ুবিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা
২ দশমিক ৯ মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত বায়ু গ্যাস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ শূন্য দশমিক ৬৯ মেগাওয়াট,
বায়োমাস থেকে উৎপাদিন বিদ্যুৎ শূন্য দশমিক ৪ মেগাওয়াট। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে যে
পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তার মধ্যে ৩৫৯ দশমিক ১১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অফগ্রিডের মধ্যে
আছে। আর ৫৮২ দশমিক ৩১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অনগ্রিডের মধ্যে আছে। অর্থাৎ ব্যবহারের বেশি
বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ করা হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সরকারি
ও বেসরকারি পর্যায়ে আরও অন্তত ৩১টি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ৫৪২ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১২টি প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এসব প্রকল্পের অবকাঠামোগত তৈরির কার্যক্রম চলমান। এ ছাড়া ১৩টি প্রকল্পের অনুকূলে লেটার
অব ইনটেন্ট (এলওআই) জারি করা হয়েছে, যার উৎপাদন ক্ষমতা হলো ৪৮৮ মেগাওয়াট। একই সঙ্গে
সরকারি খাতে আরও ছটি প্রকল্প চলমান আছে, যার উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৩৮২ মেগাওয়াট। অর্থাৎ
নবায়নযোগ্য জ্বালানির সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রক্রিয়াধীন ৩১ প্রকল্প থেকে এক হাজার
৪১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আরও অন্তত তিন হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য
জ্বালানি থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে সরকার, যার মধ্যে বেসরকারি খাত থেকে ১ হাজার
৭০০ মেগাওয়াটের লক্ষ্য রয়েছে। বাকি দুই হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ভবিষতে উৎপাদন
করা হবে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা বা কোম্পানির মাধ্যমে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা
বলেন, গত কয়েক বছরে জীবাশ্ম জ্বালানির নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ধরন এবং তাদের ক্রমবর্ধমান
খরচ নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারকে তীব্রতর করেছে। এ ছাড়া জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত
করা এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ হ্রাস করার বিষয়ে বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনেরও কিছু নির্দেশনা
রয়েছে। সরকার চেষ্টা করছে সবুজ জ্বালানি দিকে যেতে। তিনি বলেন, সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানি
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী এবং বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে।
সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, ইডকল এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক
ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছে। তা ছাড়া কিছু নবায়নযোগ্য জ্বালানি
পণ্য যেমন সোলার প্যানেল, সোলার প্যানেল প্রস্তুতের উপাদান, চার্জ কন্ট্রোলার, ইনভার্টার,
এলইডি লাইট, সৌরচালিত বাতি এবং বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপকরণের ওপর সরকার শুল্ক অব্যাহতিমূলক
প্রণোদনা প্রদান করেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সোলার
হোম সিস্টেমকে উৎসাহিত করতে সরকারি কয়েকটি কর্মসূচি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সৌর সেচ,
সৌর মিনি-মাইক্রো গ্রিড, সোলার পার্ক, সোলার রুফটপ, সোলার বোটিং ইত্যাদি। সূত্র মতে,
নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম লক্ষ্য হলো গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা এবং ডিজেলের
ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা। এর মধ্যমে একদিকে কমবে কার্বন নিঃসরণ, আরেক দিকে কমবে জ্বালানি
খাতে সরকারের ভর্তুকি।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়নবোর্ড সূত্র জানায়,
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হলো বৃহৎ আকারের সোলার
প্যানেলভিত্তিক সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা। তবে সমস্যা হচ্ছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র
নির্মাণে অবশ্যই অকৃষি জমি প্রয়োজন। কিন্তু পর্যাপ্ত অকৃষি জমি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে
অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায় না। আরেকটি সমস্যা হলো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র
থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ স্টোরেজ করা। স্টোরেজ করাও একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া।