ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে দেশের
বৃহত্তর শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে ঘায়েল
করতে ব্যর্থ হয়ে এবার নতুন চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছেন হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ওরফে বিচ্ছু
সামশু এবং তার ছেলে নাজমুল করিম শারুন চৌধুরী। তাদের সরাসরি হস্তক্ষেপে এবার আটজনকে
আসামি করে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল
সোমবার মামলাটি করেন মোসারাত জাহান মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান তানিয়া।
তবে সূত্র জানায়, এ মামলার পেছনে কলকাঠি
নাড়ছেন সামশু-শারুন সিন্ডিকেট। বিচ্ছু সামশু সিন্ডিকেটের অপকর্মের বিপক্ষে যারাই সোচ্চার
হয়, তাদের দমনে সামনে আনা হয় ‘মুনিয়া ইস্যু’। আর, ঘুরেফিরে
মুনিয়ার বোন নুসরাতই তাদের মূল অস্ত্র বা ‘দাবার গুটি’। গতকালের এ মামলায়
এমন কিছু ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে, যাঁরা দেশের বৃহত্তর শিল্পগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়ে
দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। তাঁদের মতো সম্মানিত ব্যক্তিদের আসামি করার মধ্য দিয়ে মূলত দেশের
উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় কুঠারাঘাত করা হয়েছে। এ ছাড়া মামলায় এমন কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে,
যাঁদের সঙ্গে ওই ঘটনার দূরতম সম্পর্ক নেই। এ মামলার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তারা।
তথ্য মতে, গত ১৮ আগস্ট পটিয়ার যুগ্ম জেলা
জজ আদালতে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ১১ জনকে আসামি করে একটি
মামলা করে সামশু-শারুন সিন্ডিকেট। গতকাল ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে
দায়েরকৃত মামলাটিও সেই ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত হিংসা, আক্রোশ
ও ব্লাকমেইলিংয়ের উদ্দেশ্যে মামলাটি করা হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, গতকাল দায়েরকৃত মামলায় নুসরাতের
আইনজীবী হলেন ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার
সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তিনি রাষ্ট্রবিরোধী গুজব ও অপপ্রচারকারী চক্রের অন্যতম
হোতা। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র এবং নাশকতার একাধিক মামলা রয়েছে। মুনিয়া
ইস্যু নিয়ে তারা এর আগেও রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলেন।
জানা গেছে, বিচ্ছু সামশু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে
সরকারি করোনা ভ্যাকসিন চুরি, ইয়াবা ব্যবসার গোমর ফাঁস, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, ব্যাংকার
মোর্শেদ হত্যাসহ একাধিক অনিয়ম এবং দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছিল বসুন্ধরা
গ্রুপের মালিকানাধীন বিভিন্ন গণমাধ্যম। আর, সে কারণে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান,
ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ পরিবারের একাধিক সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।
গত ২৬ এপ্রিল গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে
মোসারাত জাহান মুনিয়ার মরদেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। ঘটনার দিনই গুলশান থানায় আত্মহত্যা
প্ররোচনার অভিযোগে বসুন্ধরার এমডিকে আসামি করে মামলা করেছিলেন মুনিয়ার বোন নুসরাত।
ওই মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করেন গুলশান থানার অফিসার ইনচার্জ
(ওসি) আবুল হাসান। তদন্তের ধাপে ধাপে তিনি সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে ঘটনার চুলছেঁড়া
বিশ্লেষণ করেন। শেষপর্যন্ত মুনিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় কোন সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় মামলা থেকে
বসুন্ধরা গ্রুপের এমডির নাম প্রত্যাহার করে ১৯ জুলাই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।
২২ জুলাই ওই প্রতিবেদন গ্রহণ করেন আদালত। শুনানী শেষে গত ১৮ আগস্ট আদালত এই মামলা থেকে
বসুন্ধরার এমডিকে অব্যাহতি প্রদান করেন। পাশাপাশি পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে দাখিলকৃত
নুসরাতের নারাজি আবেদনও খারিজ করেন আদালত।
তবে অনুসন্ধান বলছে, মুনিয়ার মৃত্যুর রহস্য
শারুন চৌধুরীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। এমনকি শারুনের বিরুদ্ধে মুনিয়াকে হত্যার অভিযোগও উঠেছিল।
বিচ্ছু সামশু এবং তার ছেলের বিপক্ষে কেউ অবস্থান নিলেই নেমে আসে ভয়ংকর নির্যাতন। প্রতিশোধ
নিতে শারুন চৌধুরী এতটাই ভয়ংকর হয়ে ওঠেন যে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নিজের বান্ধবী
মুনিয়াকে হত্যা করেন। আর, নিজের অপকর্ম ঢাকতে এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মুনিয়ার বোন
নুসরাতকে কোটি টাকা দিয়ে বশ করে সাজানো মামলায় বসুন্ধরা গ্রুপের এমডিকে ফাঁসানোর অপচেষ্টা
চালিয়েছিলেন।
এদিকে, মুনিয়াকে হত্যার অভিযোগে আদালতে
শারুনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলার আবেদন করেছিলেন মুনিয়ার বড় ভাই আশিকুর রহমান সবুজ।
কিন্তু নুসরাতের আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা চলমান থাকায় আদালত তখন সবুজের আবেদনটি স্থগিত
রাখেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে সবুজের মামলার আবেদনটি স্থগিত রাখা হয়েছে, সেখানে
নুসরাতের আরেকটি মামলা নিয়ে মাতামাতির বিষয়টি রহস্যজনক। অথচ চাইলে এখন সবুজের মামলাটি
আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করা যেত।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন এ মামলায় স্বনামধন্য
ব্যবসায়ী ছাড়াও নিরপরাধ কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন শারুন চৌধুরীর
সাবেক স্ত্রী সাইফা রহমান মিম। মুনিয়ার সঙ্গে শারুনের পরকীয়ার জের ধরে তিনি স্বামীর
সংসার ছেড়ে এসেছিলেন। শারুনের নানা অপকর্মের স্বাক্ষী এই মিমকেও তাই নতুন মামলায় যুক্ত
করা হয়েছে। এমনকি প্রথম মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাকে সত্য তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করায় নতুন
মামলায় আসামি করা হয়েছে নিরপরাধ বাড়িওয়ালা দম্পতিকেও।
অন্যদিকে, নুসরাতের নতুন মামলায় আসামি
করা হয়েছে গত মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাকেও।
তাকে এ মামলায় আসামি করার কারণ হিসেবে জানা গেছে, গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে পিয়াসা শারুন
চৌধুরী সম্পর্কে স্পর্শকাতর অনেক তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন। যার কিছু অডিও রেকর্ড ভাইরাল
হওয়ায় বিপাকে পড়ে যান শারুন। সেই ক্ষোভ থেকে নুসরাতের এই সাজানো মামলায় পিয়াসাকেও আসামি
করিয়েছেন শারুন চৌধুরী।
পুলিশকে সত্য বলায় দুই বাড়িমালিকও চক্ষুশূল
: আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা তদন্তের একপর্যায়ে মুনিয়ার বাড়িওয়ালার জবানবন্দি নিয়েছিলেন
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। সে সময় ওই বাড়ির মালিক শারমিন ও তাঁর স্বামী ইব্রাহীম
আহাম্মদ রিপন গুলশান থানা পুলিশকে জানিয়েছিলেন, মুনিয়ার বাসা ভাড়ার সঙ্গে আনভীরের কোনো
ধরনের সম্পৃক্ততা ছিল না। নুসরাত এবং তার স্বামী মিজানুর রহমান নিজেদের জাতীয় পরিচয়পত্র
জমা দিয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। তদন্ত কর্মকর্তাকে সত্য তথ্য দেওয়ায় বাড়িমালিকরাও শারুন
সিন্ডিকেটের চক্ষুশূলে পরিণত হন। ষড়যন্ত্রমূলক এ মামলায় তাঁদের দুজনকেও আসামি করা হয়েছে।
মুনিয়ার ভাইয়ের মামলা অন্ধকারে : এদিকে,
মুনিয়ার মৃত্যুর ছয়দিনের মাথায় গত ২ মে শারুনকে আসামী করে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি
হত্যা মামলার আবেদন (নম্বর ১০২১/২০২১) করেন নিহতের ভাই আশিকুর রহমান সবুজ। মহানগর হাকিম
মোর্শেদ আল মামুন ভুঁইয়া আবেদনটি গ্রহণ করলেও মুনিয়ার বোনের করা আত্মহত্যায় প্ররোচনার
মামলার তদন্ত চলায় নতুন আবেদনের কার্যকারিতা স্থগিত থাকবে বলে জানিয়েছিলেন।
ওই আবেদনে সবুজ দাবি করেন, বসুন্ধরা গ্রুপের
এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের সঙ্গে শারুনের ব্যবসায়িক দ্বন্দ ছিল। এ কারণে শারুন মুনিয়ার
মাধ্যমে আনভীরের ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত তথ্য জানার চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে অসম্মতি
জানালে মুনিয়ার ওপর ক্ষিপ্ত হন শারুন। এর প্রতিশোধ নিতে শারুনই সহযোগীদের নিয়ে মুনিয়াকে
হত্যা করেন।
সবুজের দাবি, তাঁর বোন মুনিয়াকে হত্যা
করা হয়েছে। হত্যা করেছেন শারুন চৌধুরী ও তার সহযোগীরা। ঘটনার দিন শারুন তাঁর বোন মুনিয়ার
ফ্ল্যাটের ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে ঢুকে অজ্ঞাতনামাদের সাহায্য নিয়ে হত্যা করেন। পরে তাঁর
বোনের লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে কৌশলে বাসা থেকে বের হন। সবুজের দাবি, তার বোন
নুসরাত জাহান আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা করার আগে তার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেননি। নুসরাত
প্রকৃত ঘটনা জানেন না বলেও দাবি করেন তিনি।
গোমর ফাঁস করায় পিয়াসাও আসামি : গত ১ আগস্ট
অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, মাদকসহ ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা নামে কথিত এক মডেলকে গ্রেপ্তার
করে র্যাব। এসময় মরিয়ম আক্তার মৌ নামে তার এক সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাদের
রিমান্ডে নিলে যেন ‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসা’র মতো ঘটনা ঘটে।
পিয়াসার জবানবন্দিতে উঠে আসে বিভিন্ন রাঘববোয়ালের অনেক কুকীর্তির কথা। সেসব রাঘববোয়ালদের
মধ্যে অন্যতম শারুন চৌধুরী। রিমান্ডে পিয়াসা খুলে দেন নারী কেলেঙ্কারীসহ শারুন-সামশুলের
অন্ধকার জীবনের নানা অধ্যায়। পিয়াসার সেই জবানবন্দি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে
পড়েছিল।
সূত্র জানায়, এ ঘটনায় পিয়াসার ওপর ক্ষুব্ধ
হয়ে ওঠেন শারুন। তাই পিয়াসাকে ঘায়েল করতে নুসরাতের নতুন মামলায় কৌশলে তাকেও আসামি করা
হয়।
সাবেক স্ত্রীকেও ফাঁসাতে চান শারুন : অনেক
সুখের স্বপ্ন নিয়ে শারুন চৌধুরীর সঙ্গে ঘর বেঁধেছিলেন সাইফা রহমান মিম। কিন্তু বিয়ের
কিছুদিন না যেতেই সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় তার। মাদকসেবী ও অর্থলোভী স্বামীর হাতে প্রায়ই
শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাকে। নির্যাতনের পেছনে ছিল মুনিয়ার সঙ্গে তার
স্বামী শারুনের পরকীয়া। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে শারুনের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন
সাইফা রহমান মীম। এরপরও মুখ বুজে সংসার টিকিয়ে রাখতে চেয়ছিলেন মিম। একপর্যায়ে শারুন
যখন তাকে প্রাণে মারার চেষ্টা করেন তখন আর চুপ থাকেননি মিম। শারুন ও শ্বশুর সামশুল
হক চৌধুরী ওরফে বিচ্ছু সামশুসহ পরিবারের নির্যাতন সইতে না পেরে শেষপর্যন্ত শারুনকে
তালাক দেন তিনি। শুধু তাই নয়, ভয়ংকর শারুন চৌধুরী সাইফা মীমের একমাত্র শিশু কন্যাকেও
জোর করে আটকে রাখেন। এই ঘটনায় মিম আদালতে ৩০৬, ৩০৭, ৩২৭, ৩৪০ ও ৩৭৭ ধারায় একটি মামলার
আবেদন করেন। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে সেই আবেদন গ্রহণ করেননি আদালত।
এ বিষয়ে মীম গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘শারুনের শারীরিক-মানসিক
নির্যাতনের কারণে আমি কয়েক দফা সুইসাইড করার চেষ্টা করি। মোসারাত জাহান মুনিয়াসহ বহু
নারীর সঙ্গে শারুনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। মুনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে কথা বললে সে আমাকে
বেধড়ক মারধর করে। এমনকি আমি ও আমার মা-বাবাকে হত্যার হুমকি দেয়। তার সঙ্গে সবসময় পিস্তল
থাকে, ওই পিস্তল উঁচিয়ে ভয় দেখায়।’
মীম আরও বলেন, শেষপর্যন্ত তাদের নির্যাতনের কাছে হার মানতে হয়। মুনিয়ার পরকীয়ার কারণেই আমাকে ঘরছাড়া হতে হয়েছিল। এমনকি আমার শিশুকন্যাকেও আবার বুক থেকে কেড়ে নিয়েছে। একটিবার দেখতেও দেয় না। এখন প্রতিশোধ নিতে সেই শারুনের বান্ধবী মুনিয়ার বড় বোন বাদী হয়ে আমার বিরুদ্ধেও মামলা করেছে। কিন্তু আমি যে মামলা শারুনের বিরুদ্ধে করতে চেয়েছিলাম সেটা শারুন সিন্ডিকেটের অদৃশ্য হাতের ইশারায় মামলাটি আমলে নেয়া হয়নি।