পিরোজপুরে সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটিসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নির্বাচনে বিজয়ী নৌকা প্রতীকের প্রার্থীসহ তার কর্মী সমর্থকদের অভিযোগ- স্বতন্ত্র প্রার্থী আউয়ালের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ দেয়া হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাল্পনিক অভিযোগের ভিক্তিতে নৌকার কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনে প্রতিবেদন প্রেরণ করেছেন নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি।
এছাড়া ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর নাজিরপুর ও ইন্দুরকানী উপজেলার সকল ভোট কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা করা হলেও রহস্যজনক কারণে পিরোজপুর পৌর এলাকার ভোট কেন্দ্রগুলোর ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব করা হয়েছে।
অপরদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে অখ্যাত-কুখ্যাত পত্রিকার রেফোরেন্সে ১৫ থেকে ২০ জনের নামে সাংবাদিক পর্যবেক্ষক কার্ড ইস্যু করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি ও রিটার্নিং অফিসার দায় চাপাচ্ছেন নির্বাচন কমিশনের ওপর।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্বতন্ত্র প্রার্থী আউয়ালের ভাই পিরোজপুর পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক, পৌর কাউন্সিলর আবুয়াল শিকদার, পৌর কাউন্সিলর সাদউল্লাহ লিটন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমন শিকদার, জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আউয়াল পরিবারের ঘনিষ্ঠ কর্মী রফিকুল ইসলাম সুমন স্বতন্ত্র প্রার্থী আউয়ালে বিভিন্ন নির্বাচনী পথসভায় প্রকাশ্য নৌকার প্রার্থী নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, নৌকার কর্মীদের নানা হুমকি দেয়। এসব হুমিকর ভিডিও সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ধরনের বক্তব্য ও কার্যকলাপকে নির্বাচনী আচরণবিধির চরম লঙ্ঘণ বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পিরোজপুরের পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক বলছেন, ‘আমরা শুনেছি নাজিরপুরের অনেক লোকজনকে এখন থ্রেট দেয় (ভয় দেখান)। কিন্তু আমাদের যদি কেউ রক্তচক্ষু দেখানোর চেষ্টা করেন, আমরা তাদের চক্ষু তুলে দেয়ার ক্ষমতা রাখি।’
অপর এক ভিডিওতে দেখা যায়, আবুয়াল সিকদার স্বতন্ত্র প্রার্থী একেএমএ আউয়ালের সমর্থনে একটি জনসভায় প্রকাশ্যে একই রকমভাবে হুমকি দেন। মন্ত্রীর নাম ধরে ওই জনসভায় আবুয়াল শিকদার বলেন, ‘আপনারা তাকে চেনেন নাই, আমি ছোটকাল হতে চিনি। রেজাউল করিম একজন খুনি। তুমি এই দুই নং ওয়ার্ডবাসীর কাউকে কোনো লোক দিয়ে যদি চক্ষু লাল করাও, তার চোখ আমরা তুলে দেবো। এটা দুনিয়ার কেউ রাখতে পারবে না। আমি তোমারে (মন্ত্রী রেজাউলকে) বলতে চাই, তুমি যেভাবে আছো, সেভাবে ঠাণ্ডাভাবে নির্বাচন করে মাঠ থেকে ওঠো।’
অপর এক ভিডিওতে দেখা যায়, সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য আউয়াল পরিবারের ঘনিষ্ঠ কর্মী রফিকুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘পিরোজপুর সদর উপজেলা এবং পৌরসভায় যেন নৌকার কোনো এজেন্ট না দিতে পারে। ভোট তো দূরের কথা, কোনো এজেন্ট যেন না দিতে পারে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’
একই ভাবে পিরোজপুর পৌর কাউন্সিলর সাদউল্লাহ লিটন নৌকার প্রার্থী শ ম রেজাউল করিম ও তার পরিবার সর্ম্পকে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দেয়।
নৌকার প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়কারী শিকদার মো. চান বলেন, নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএমএ আউয়ালের কর্মী-সমর্থক ও ক্যাডাররা নৌকার প্রচার-প্রচারণায় বাধা, নিবাচনী অফিস ভাঙচুর, কর্মীদের মারধর, নৌকার পক্ষে কাজ না করার জন্য মোবাইলে এবং পথসভায় প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছে। এসব ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থী আউয়ালসহ তার ভাই পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক, পৌর কাউন্সিলর আবুয়াল শিকদার, পৌর কাউন্সিলর সাদউল্লাহ লিটন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সুমন শিকদার, নাজিরপুর উপজেলার দীর্ঘা ইউপি চেয়ারম্যান আশুতোষ বেপারীসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন, নিবাচন অনুসন্ধান কমিটি ও রির্টানিং অফিসার বরাবরে প্রমাণাদিসহ লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন নৌকার প্রার্থী শ ম রেজাউল করিম। নিবাচন অনুসন্ধান কমিটি অভিযোগের বিষয়গুলো তদন্ত করেছেন, ভুক্তভোগীসহ সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন। তাদের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণে ঘটনার সত্যতা মিললেও কোনো প্রকার আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী আউয়ালের পক্ষ নেন সংশ্লিষ্টরা।
নৌকা প্রতীকের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আরেক সমন্বয়কারী পিরোজপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান এসএম বায়জীদ হোসেন বলেন, নিবাচন অনুসন্ধান কমিটি নৌকা হারাতে নৌকার কর্মী সমর্থকদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী আউয়ালের কাল্পনিক অভিযোগের ভিক্তিতে কোনো প্রকার যাচাই-বাচাই না করে নৌকার কর্মী এম খোকন কাজীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের হাত-পা ভেঙে দেয়াসহ হত্যার হুমকি এবং এসএম নজরুল ইসলাম ও নুরে আলম শাহীনের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের চাইনিজ কুড়াল দিয়ে হত্যার চেষ্টা এবং লোহার রড় দিয়ে জখম করার অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে নির্বাচন কমিশনে প্রতিবেদন প্রেরণ করে পিরোজপুরের নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটি। ওই প্রতিবেদনের আলোকে নির্বাচন কমিশনের আদেশে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া কথা হয়েছে।
আরেক সমন্বয়কারী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কামরুজ্জামান খান শামীম বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ নিয়ে রির্টানিং অফিসার স্বতন্ত্র প্রার্থীর ১৫/২০ জন কর্মী/ক্যাডারকে অখ্যাত-কুখ্যাত পত্রিকার রেফারেন্সে সাংবাদিক পর্যবেক্ষক কার্ড প্রদান করেন। প্রকৃত পক্ষে তারা কেউ সাংবাদিক নয়। তাদের মধ্যে একজন আলী ইমাম অন্তু হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। তারা সাংবাদিক হিসেবে পর্যবেক্ষক কার্ড নিয়ে নাজিরপুর উপজেলার বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করে নৌকার এজেন্টদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পিরোজপুরের নির্বাচন অনুসন্ধান কমিটির প্রধান যুগ্ম জেলা জজ বেগম রুবাইয়া আমেনা বলেন, নির্বাচন চলাকালীন প্রার্থীদের দেয়া সকল অভিযোগ তদন্ত করে বিধি মোতাবেক নির্বাচন কমিশনে প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয়েছে। কমিশন কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বা নেয়নি, তা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। এ ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারবো না। এ বিষয়ে জানতে হলে আপনাকে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
সকল অভিযোগ অস্বীকার করে রিটার্নিং অফিসার ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান বলেন, নির্বাচন চলাকালীন প্রার্থীদের যে সকল অভিযোগ পাওয়া গেছে, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নিবাচন অনুসন্ধান কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া আমি নিজেও কয়েকটি ঘটনা দেখেছি, প্রত্যেকটি ঘটনায় যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেই একটি সুন্দর, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব হয়েছে। তাছাড়া স্থানীয় নির্বাচন অফিসের তালিকা অনুযায়ী পর্যবেক্ষক কার্ড ইস্যু করা হয়েছে।