টানা তিন মাসের নিষেধাজ্ঞার পর রোববার থেকে বনজীবী ও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে সুন্দরবন। খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, সুন্দরবনে সম্পদ আহরণের জন্য ১২ হাজার নৌকা ও ট্রলারকে বোর্ড লাইসেন্স সার্টিফিকেট-বিএলসি দেওয়া হয়। এসব নৌযানের মাধ্যমে প্রতিবছর এক থেকে দেড় লাখ জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়াল সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ করেন।
তিনি বলেন, সুন্দরবন শুধু জীববৈচিত্র্য নয়, মৎস্য সম্পদেরও আধার। জুন থেকে অগাস্ট-এই তিন মাস প্রজনন মৌসুম হওয়ায় সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশিরভাগ মাছ ডিম ছাড়ে। এ কারণে তিন মাসের জন্য জেলে ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বন বিভাগ।
এ বন সংরক্ষক আরও বলেন, “১ সেপ্টেম্বর থেকে জেলে ও পর্যটকদের সুন্দরবনে ঢোকার পাস (অনুমতি) দেওয়া হবে। নির্ধারিত ফরেস্ট স্টেশনগুলোকে এ বিষয়ে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।” অনুমতিপত্রের মেয়াদ অনুযায়ী, সুন্দরবনে অবস্থানকারী জেলেদের তালিকা বনরক্ষীদের ক্যাম্প কর্মকর্তার কাছেও থাকবে। বনরক্ষীরা তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি খালে টহল দিয়ে অনুমোদন পাওয়া জেলেদের নৌকা যাচাই করে দেখবেন।
বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, জেলে-বাওয়ালিরাও এখন সুন্দরবনের ভেতরে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।তবে সাধারণ জেলে-বাওয়ালিদের অভিযোগ, নিষিদ্ধ সময়ে সুন্দরবনে অপরাধ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার স্থানীয় জেলেদের কয়েকটি অসাধুচক্র বন বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপন চুক্তির মাধ্যমে সুন্দরবনে ঢুকে অল্প সময়ে বিষ ছিটিয়ে মাছ ও কাঁকড়া শিকার করছেন।বনের ভেতরে গাছ পুড়িয়ে চলে শুঁটকি তৈরি। দেশ-বিদেশের বাজারে ওই চিংড়ির শুঁটকির চাহিদা ও দাম বেশি।মাছ ও কাঁকড়া সুন্দরবনসংলগ্ন আশপাশ এলাকার আড়ত এবং বাজারে প্রকাশ্যে বিক্রি হয়।এতে প্রকৃত জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তারা।
এ বিষয়ে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমারের ভাষ্য, “নিষিদ্ধ মৌসুমে সুন্দরবন কেন্দ্রীক সব ধরনের অপরাধ দমনে সচেষ্ট থাকেন বনরক্ষীরা। তবে এর মধ্যে দুএকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে।”দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বনরক্ষীদের কারও বিরুদ্ধে অবহেলা অথবা অপরাধীর সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান এই বন কর্মকর্তা।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার; যা পুরো সুন্দরবনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ শতাংশ। ১৩টি বড় নদীসহ ৪৫০টির মত খাল রয়েছে সুন্দরবনে।
জোয়ারে পানিতে প্লাবিত হওয়া এই বনের জলাধার ভেটকি, রূপচাঁদা, দাঁতিনা, চিত্রা, পাঙ্গাশ, লইট্যা, ছুরি, মেদ, পাইস্যা, পোয়া, তপসে, লাক্ষা, কই, মাগুর, কাইন, ইলিশসহ ২১০ প্রজাতির সাদা মাছের আবাস।এছাড়াও রয়েছে গলদা, বাগদা, চাকা, চালি, চামিসহ ২৪ প্রজাতির চিংড়ি।বিশ্বখ্যাত শিলা কাঁকড়াসহ ১৪ প্রজাতির কাঁকড়ার প্রজনন হয় এখানে।
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সুন্দরবনের প্রতি সব দেশের মানুষের আকর্ষণ রয়েছে। সুন্দরবনের সাতটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে প্রতিবছর আড়াই লাখের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন।বন বিভাগ থেকে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সুন্দরবন ভ্রমণ করেন ২ লাখ ১৬ হাজার পর্যটক। যা থেকে সুন্দরবন বিভাগের রাজস্ব আয় হয় ৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরে সুন্দরবনে ৭৫ হাজার ৫৬০ জন দেশি এবং ৮৬৪ জন বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেছেন। ওই অর্থবছর সুন্দরবন বিভাগ পর্যটকদের কাছ থেকে ৮৮ লাখ ৯৪ হাজার ৭০ টাকা রাজস্ব আয় করে।
খুলনার ট্যুর অপারেটরা জানান, সুন্দরবনে পর্যটনের মৌসুম শুরু হয় অক্টোবরে, চলে মার্চ পর্যন্ত। এই ছয় মাসের ব্যবসার জন্য এ খাতের ব্যবসায়ীরা অপেক্ষায় থাকেন। তবে গত মৌসুম দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সুন্দরবন কেন্দ্রীক পর্যটন ব্যবসায় ধস নামে।