অর্থনৈতিক গুরুত্বের কারণে রাবারকে সাদা সোনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্বের প্রায় ৪৬ হাজার পণ্য তৈরী হয় রাবারের মাধ্যমে।
বাংলাদেশে রাবার শিল্পের যাত্রা শুরু ১৯৬০ সালে। বর্তমানে দেশে রাষ্ট্রয়াত্ব বাগানের সংখ্যা ১৮টি। এছাড়া ছোট-বড় বেশ কিছু ব্যক্তি মালিকানাধিন বাগান রয়েছে। দেশে প্রতি বছর রাবারের চাহিদা প্রায় ২০ হাজার টন। এর বিপরীতে দেশে বছরে উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ১১ হাজার টন। এর মধ্যে সরকারি বাগান থেকে বছরে ৬ হাজার টন এবং ব্যক্তি মালিকানাধিন বাগান থেকে ৫.৫০ হাজার টন রাবার উৎপাদন হচ্ছে। বাকি রাবার আমদানি করতে হচ্ছে বিভিন্ন দেশ থেকে।
রাষ্ট্রয়াত্ব ১৮টি বাগানের মধ্যে একটি শাহজীবাজার রাবার বাগান। ২ হাজার ১০৪ একর জায়গা নিয়ে ৮০ দশকে হবিগঞ্জের মাধবপুরে বাগানটি গড়ে তোলা হয়। একসময় লাভজনক থাকলেও ২০১৩ সালের পর থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লোকসান গুণতে হচ্ছে বাগানটিকে। গেল ১০ বছরে বাগানের লোকসানের পরিমাণ প্রায় ৫৭ কোটি টাকা।
বাগান কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ি ২০১৩-১৪ অর্থবছর ৪ কোটি ৫৭ লাখ, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৪ কোটি ৭০ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৪ কোটি ২৬ লাখ, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৪ কোটি, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৩ কোটি ৬৪ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৭ কোটি ৮৮ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছর ৭ কোটি ৮০ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছর ৭ কোটি ৭৪ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছর ৫ কোটি ৭১ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছর ৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ বলছে- অপরিকল্পিতভাবে বাগান পরিচালনা, গাছের জীবনচক্র শেষ এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া লোকসানের বড় কারণ।
বাংলাদেশ রাবার বোর্ডের তথ্য বলছে, মূলত একটি রাবার গাছের কষ দেওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা থাকে ৩০ থেকে ৩২ বছর পর্যন্ত। কিন্তু শাহজীবাজারের গাছগুলোর বয়স প্রায় ৪০ এর বেশি। ফলে এক দশক আগেই কষ দেওয়ার স্বাভাবিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে বাগানটি। যে কারণে দিনদিন কমছে কষ সংগ্রহের পরিমাণ।
শাহজীবাজার রাবার বাগানে নিয়মিত কাজ করেন আড়াইশ’ শ্রমিক। কাকডাকা ভোরে এসব শ্রমিক কষ সংগ্রহে নামেন। বাগানের ঝোপঝাড়ে কাজ করায় সাপ-বিচ্ছু, বিষাক্ত পোকামাকড় আর বন্যজন্তুদের আক্রমণের শঙ্কা থাকলে নেই নূন্যতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সেই সাথে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছে এসব শ্রমিকদের।
১৫ বছরের বেশি সময় ধরে এই বাগানে কাজ করেন আব্দাল মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমরা যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে চলা বর্তমান সময়ে অনেক কঠিন। এখানে ওভারটাইম করার কোন সুযোগ নেই। এছাড়া আমাদের নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থাও নেই। প্রতি বছর শীত মৌসুমে আমাদের জুতা, গ্লাবস, রেইনকোর্ট দেওয়ার কথা। কিন্তু কোন কিছুই দেওয়া হয় না। চাইলেই শুধু বলে বাগান লোকসানে আছে।’
শাহজীবাজার রাবার বাগানের সহকারি মাঠ তত্বাবধায়ক মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘গাছ থেকে কষ সংগ্রহের পর সেটিকে আনা হয় রাবার প্রসেসিং সেডে। এখানে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তরল কষকে সেডে রূপান্তর করা হয়। কিন্তু এই বাগানে যে যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয় সেগুলো অনেক পুরনো। আধুনিক যন্ত্রাংশ না থাকায় একদিকে রাবারের সেড তৈরী করতে গিয়ে সময় বেশি লাগছে, অন্যদিকে কমছে রাবারের গুণগত মান। বাগানের গাছগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। বয়স বেশি হওয়ায় গাছগুলোতে যতেষ্ট কষ আসে না। সেই সাথে অর্ধেকের চেয়ে বেশি গাছ থেকে এক ফোটা কষও পাওয়া যায় না। সেগুলোতে পোকামাকড় আক্রমণ করেছে।’
শাহজীবাজার রাবার বাগানের ব্যবস্থাপক নন্দী গোপাল রায় বলেন, ‘অনেক কারণে বাগানটি দিনের পর দিন লোকসান গুণেছে। এর মধ্যে তিনটি বড় কারণ অপরিকল্পিতভাবে বাগান পরিচালনা, গাছের জীবনচক্র শেষ এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া লোকসানের বড় কারণ। গত ১০ বছরে রাবার উৎপাদনে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। বর্তমানে শাহজীবাজার বাগানে প্রতিকেজি রাবার উৎপাদনে খরচ হচ্ছে সাড়ে ৩শ’ টাকার বেশি। বিপরীতে বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকায়।’
তিনি বলেন, ‘রাবার মুলত কৃষিপণ্য। কিন্তু এনবিআর এটিকে শিল্প হিসেবে তালিকাভুক্ত করায় শুকনো রাবার বিক্রির সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৪ শতাংশ আয়কর পরিশোধ বাধ্যতামূলক। এনবিআরের এমন সিদ্ধান্ত রাবার শিল্পের উন্নয়নে প্রধান অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে একটি মামলা চলছে। যার বিস্তারিত বলতে পারবেন আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।’
নন্দী গোপাল রায় বলেন, ‘আমি এখানে কয়েক মাস আগে যোগদান করেছি। যোগদান করার পরই বাগানটিকে লাভজনক করতে ১০ বছরের একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি রাবার বোর্ডে। মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন হলে এই সংকট থেকে উত্তোরণ সম্ভব হবে। যদিও এর কিছু কাজ শুরু হয়েছে। যেমন এরই মধ্যে পরিত্যক্ত গাছ কেটে দেড় হাজার হেক্টর জায়গাজুড়ে নতুন চারা লাগানো হয়েছে। পর্যক্রমে বাকি বাগানও এভাবে পুনর্বাসন করা হবে।’