
সরকারি নীতিমালা অনুসারে অটো রাইস মিল করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, ট্রেড লাইসেন্স, শিল্প সনদ, ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স, ফুড লাইসেন্স এবং চকিদারি খাজনা রশিদ প্রদান করে অটোরাইস মিল স্থাপন করার কথা এবং আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জনগুরুত্বপূর্ণ এলাকা ব্যতিরেকে অটো রাইস মিল স্থাপন করার নির্দেশনা রয়েছে।
কিন্তু শিল্পাঞ্চল ও জনবহুল সাভারে উপজেলায় বেশিরভাগ রাইস মিল গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকায়। শুধু তাই নয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশেপাশেও কিছু কিছু প্রভাবশালী ব্যাবসায়ীরা গড়ে তুলেছেন অটো রাইস মিল। এতে ধোঁয়া, ছাই ও শব্দদূষণে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে জনজীবন। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সেই সাথে মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ।
সাভার-আশুলিয়ার এ সকল রাইস মিলের কারো কারো পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র থাকলেও নিবন্ধন নেই খাদ্য অধিদপ্তরের।
একটি অটো রাইস মিল কারখানায় প্রিলি ক্লিনার, প্যাডি ক্লিনার, বয়লার, ড্রায়ার পেডি হাস্কার, পেডি সেপারেটর, রোটারি শিফটার, লেন্থ গ্রেডার, কালার সার্টার, ডিস্টোনার, থিকনেস গ্রেডার, হোয়াইটনার, সিল্কি পলিশার যন্ত্রপাতি গুলো যথাযথভাবে থাকতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ অটো রাইস মিলে এ সকল যন্ত্রপাতি নাই, কারো কারো থাকলেও খরচ বেড়ে যাওয়ার ভয়ে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করছে না তারা। যার ফলে এসকল রাইস মিলের উৎপাদিত চাউলের মান যেমন ঠিক থাকছে না, অন্যদিকে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে খুব সহজেই।
যেমন সাভারের শিমুলিয়া ইউনিয়নের রাঙ্গামাটি আনাইল বাড়ি এলাকায় মেসার্স ভান্ডারী
অটো রাইস মিলের খাদ্য অধিদপ্তর লাইসেন্সের তালিকায় নাম থাকলেও একই ইউনিয়নের ঘনকপাড়া
এলাকার সোনালী অটো রাইস মিলের নাম পাওয়া যায়নি ঐ তালিকায়। এছাড়া এই ইউনিয়নের তিনটি
রাইস মিল সহ সাভার উপজেলায় অবস্থিত বেশিরভাগ রাইস মিল আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠেছে, এবং
বেশিরভাগই রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির বাহিরে।
শিমুলিয়া ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা তুহিন জানান মেসার্স ভান্ডারী অটো রাইস মিল কারখানাটি আবাসিক এলাকার ব্যস্ততম চলাচলের রাস্তা ঘেঁষে স্থাপিত। তাদের ধান গমের গাড়ি যখন আসে ঘন্টার পর ঘন্টা ওই রাস্তায় জ্যাম পড়ে থাকে। এতে জরুরি মুহূর্তে একটি রিক্সা নিয়েও পারাপার হওয়ার জায়গা থাকে না। ধোঁয়া এবং ছাইয়ের ভোগান্তি তো আছেই। যখন তাদের ধোঁয়া ছাড়া শুরু করে আশেপাশে পাঁচ মিনিট দাঁড়ানো সম্ভব হয় না। তাছাড়া রাইস মিলটির দুই আড়াইশো গজের মধ্যে রয়েছে একটি স্কুল।
এ বিষয়ে জানতে ভান্ডারি রাইস মিলের মালিক ইব্রাহিমের মুঠো ফোনে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এছাড়াও শিমুলিয়া গোয়ালবাড়ি বাজার হুমায়ূন কবির মালিকানাধীন রোহিজ সরকার রাইস মিল খাদ্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হলেও কার্যক্রম পরিচালনা করতে নেই কোন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, বয়লার ব্যবস্থা ও ধোঁয়া ও ছাই সরানোর স্লাইক্লোন প্রযুক্তি।
রোহিজ রাইস মিল মালিক হুমায়ুন কবিরের নাম্বারে ফোন করলে তার ভাই জাহাঙ্গীর আজকের দর্পণ কে বলেন, 'আমাদের রাইস মিলের তেমন কোন কার্যক্রম এখন আর নেই। তবে শুধু গৃহস্থদের ধান ভাঙ্গানো ও ছাঁটাই এর কাজ করে থাকি'। খাদ্য অধিদপ্তরে তালিকাভুক্ত হওয়ায়, ধান ও খাদ্যজাত পণ্য গুদামজাত ও সরকারের কাছে খাদ্যশস্য বিক্রি বা গ্রহণ করছেন কিনা জানতে চাইলে, তিনি তা অস্বীকার করেন।
অটো রাইস মিল অনুমোদনের আগে ধোঁয়া ও ছাই নিষ্কাশনে স্লাইক্লোন প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হয়। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ মিল মালিকরা তা করেননি। যদিও কেউ কেউ এই প্রযুক্তি স্থাপন করেছে, কিন্তু বিদ্যুৎ বিল ও খরচ বাঁচাতে তা বন্ধ রাখছেন বলে অভিযোগ করছেন এলাকাবাসী। এতে ধান ক্রাশিংয়ের সময় ধোয়া ও ছাই আবাসিক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশ ও সাধারণ মানুষের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
ধোঁয়া ও ছাই অপসারণের স্লাইক্লোন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে, সাভারের গনকপাড়ায়
অবস্থিত সোনালী অটো রাইস মিলের মালিক জসিম উদ্দীন বলেন, ধোঁয়া ও ছাই অপসারণের স্লাইক্লোন
প্রযুক্তি কি, এ সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নেই, আমি কখনো এর নাম শুনিনি, আমারটা ফুল
অটো রাইস মিল সেমিঅটো না ভাই। আর ধোঁয়া সামান্য বাহিরে যায় তাও অনেক উপরদিয়ে। ধোঁয়ায়
ক্ষতিগ্রস্ত কেউ আমার কাছে কখনো অভিযোগ করেনি।
সাভার উপজেলার নয়ার হাট আমগাছি এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা শরিফ উদ্দিন বলেন, আমরা যে অসুবিধায় আছি তা দেখার কেউ নাই। মিতালি অটো রাইস মিল থেকে নদীর পাশ দিয়ে যেভাবে ছাই যায় এতে করে মানুষের অনেক সমস্যা হয়, এগুলো ধরা উচিত, সে অটো রাইস মিল করেছে আবাসিক এলাকায়, তার মিলের পাশে আমার জায়গা আছে, আমি যে বাড়ি করব তার কোন উপায় নাই। রাইস মিলের ধোঁয়া আসে রাইস মিলের ছাই আসে। পরিবেশ অধিদপ্তরে আমরা অনেকবার জানাইছি অভিযোগ করছি তারা কি করে বুঝিনা। ছাই এবং ধুলাবালি উড়ে আইসা কি একটা অবস্থা। গ্রামের মানুষ থাকাই যায় না এদের কারণে।
নয়ারহাট আমগাছিয়া শাহ-ই আলম মালিকানাধীন মেসার্স মিতালী রাইস মিল এর ম্যানেজার তারা মিয়া বলেন, আমাদের রাইস মিল পুরোপুরি অটো রাইস মিল আমাদের সব ধরনের প্রযুক্তি আছে, এবং সবগুলো আমরা সঠিক মত ব্যবহার করছি, সবকিছু একদম কমপ্লিট আমাদের কোন কাগজের ফাঁকফোকর নাই। প্রতিমাসে খাদ্য অধিদপ্তরের ফরম করে জমা দিয়ে দিই সাভারে।
আবাসিক এলাকায় রাইস মিল হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, এগুলো হলো মানুষের ভুল ধারণা, ধামরাইতে পৌরসভার ভিতরে অটো রাইস মিল আছে আমাদেরটা তো নদীর পাড়ে, অনেক কিছু কিছু মানুষ আছে তারা এসব অভিযোগ করে। আমাদের এখানে আসলে বুঝতে পারবেন। এটা তো একটু স্বাভাবিক, মনে করেন দেশে আমি বাস করি, আমার পক্ষে ১০ জন থাকে ভালো বলে, ৫ জন খারাপ বলবেই এই ধরনের।
খাদ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের চাউল সংগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণ আদেশ প্রজ্ঞাপন ২০০৮ এ ৪ এর ১ এ বলা হয়েছে, ধান ছাটাই করন ও এ সংক্রান্ত ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারের নিকট হইতে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে কোন ব্যক্তি শক্তিচালিত যন্ত্রপাতি দ্বারা ধান ছাটাই করণ, ধান ও চাউল ক্রয় বিক্রয় এবং চাউলজাত দ্রব্যাদি প্রস্তুতকরণ ও বিক্রয় সংক্রান্ত ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে না।
রাইস মিলগুলোর চাউল এর মান ঠিক রাখতে যেহেতু প্রজ্ঞাপনের ৫ এর ৪নং এ বলা হয়েছে প্রত্যেক লাইসেন্স প্রাপ্ত ব্যক্তি তাহার চাউল কলে মজুদ সংগৃহীত ছাটাইকৃত বিলিকৃত এবং অবশিষ্ট ধান ও চাউল সম্পর্কে প্রতি ১৫ দিন অন্তর একটি প্রতিবেদন ফরম এবং চাউল কলের জন্য মজুদকৃত ধান ও চাউলের পরিমাণ ও গুদামের অবস্থান সম্পর্কে ঘোষণাপত্র ফরম, সংশ্লিষ্ট জেলার ডেপুটি কমিশনারের নিকট দাখিল করিবেন। সে ক্ষেত্রে অধিকাংশ রাইস মিলের খাদ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স না থাকায়, তাদের ছাঁটাইকৃত ও বাজারজাত চালের মান সম্পর্কে যাচাই করার কোন সুযোগ থাকছে না।
২০১৮ সাল পর্যন্ত খাদ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যে, সাভার উপজেলায় মাত্র ১২টি রাইস মিলের লাইসেন্স তালিকায় নাম পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে দেখা যার অধিকাংশই অনেক দিন আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এছাড়া নতুন যারা ব্যবসা শুরু করেছেন তাদের তালিকা হয়নি অনেকেরই।
খাদ্য অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা আঞ্চলিক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মকর্তা আনিছুর রহমান আজকের দর্পণ কে বলেন, 'সাভারে ১২ টি অটো রাইস মিল তালিকা ভুক্ত রয়েছে। তালিকা বহির্ভূত অটো রাইস মিল থাকতেই পারে, যারা অটো রাইস মিল ময়দা মিল করবে তাদেরকে আমরা ছাড়পত্র দিব। তবে তালিকাভুক্ত হতেই হবে এটা কোন জরুরী না। যদি কেউ আমাদের তালিকাভুক্ত হতে চায় তখন আমরা তাদের সবকিছু চেক করে দেখি মানোন্নয়ন ঠিক আছে কিনা। যদি তালিকাভুক্ত হয় তখন ময়দা তৈরি চাউল তৈরি করার ক্ষেত্রে গম ও ধান সরকারি রেটে নিতে পারবে, এবং চাল উৎপাদন করে আবার বিক্রি করতে পারবে। মান ঠিক রাখার জন্য আমি শিওর না, যেহেতু আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের নির্দেশনা দিলে আমরা শুধু গিয়ে পরিদর্শন করি দেখি, আমাদের ক্রাইটেরিয়ার ভিতরে আছে কিনা'।
এ বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে, তিনি ফোনে রিসিভ করেননি।
আশুলিয়া উন্নয়ন ফোরামের সেক্রেটারি ব্যারিস্টার বাকের হোসেন মৃধা বলেন, আশুলিয়া একটি জনবহুল শিল্পাঞ্চল এলাকা, এই আবাসিক এলাকায় অটো রাইস মিল থাকাটা অবশ্যই পরিবেশবিরোধী ও সাধারন মানুষের স্বাস্থ্য বিরোধী। যেহেতু কর্তৃপক্ষ আবাসিক এলাকার এই রাইস মিল গুলোর তদারকি ঠিকমতো করতে পারছে না, তাই এটা অতি দ্রুত বন্ধ হওয়া উচিত। এটা যদি নিউজ হয় আমরা কোর্টে রিট করব। অনেক মিল মালিকদের পরিবেশ অধিদপ্তরে ছাড়পত্রের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তারা রাইস মিলগুলো পরিচালনা করছে, এটা বন্ধ হওয়া উচিত। পরিবেশ অধিদপ্তরের এ বিষয়ে আরো তদারকি করা উচিত বলে আমি মনে করি। যেন আমাদের আবাসিক এলাকায় সাধারণ জনগণ ও পরিবেশের ক্ষতি সাধন না হয়। এ ব্যাপারে আমররা আশুলিয়া বাসীর স্বার্থে প্রয়োজনে কোর্টে রিট করব'।
পরিবেশে অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (ঢাকা অঞ্চল) মুক্তাদির হাসান জানান, এ এলাকা(সাভার) আমি দেখিনা। আমিত বিভাগে কাজ করি। ওখানে অন্য কর্মকর্তা রয়েছেন। তার সাথে যোগাযোগ করেন।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক জহিরুল ইসলাম তালুকদারের মুঠোফোনে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
পরিবেশে অধিদফতরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা শাখার উপ-পরিচালক বেগম শাহানাজ রহমান আজকের দর্পণ কে বলেন, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে এই বিষয়টি জানিয়ে মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলে, অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা হবে। আবাসিক এলাকায় রাইস মিল চালানোর ক্ষেত্রে যদি আমাদের ছাড়পত্র থেকে থাকে, তাহলে হয়তো চেয়ারম্যান সাটিফিকেট আশেপাশের মানুষের নো অবজেকশন ছিল এরকম অনেক গুলো বিষয় দেখেই তাদের ছাড়পত্র দিছে। অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয় চেক করা হবে।