বগুড়ার শেরপুরের বাজারগুলোতে অনেক মাছ বিক্রেতাই মাছের আঁশ থেকে আয় করছে বাড়তি টাকা। এতে তাদের পরিবার যেমন বাড়তি অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাচ্ছে তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখছে।
শেরপুরের বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রায় ৬/৭ জন বড় মাছ বিক্রেতা মাছের আঁশ সংগ্রহকারী রয়েছে। কথা হয় নিয়ত আলি, আনিস, বকুল এবং আসাদের সাথে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে শেরপুর থেকে প্রতিমাসে সবমিলিয়ে গড়ে প্রায় দুই মন আঁশ সংগ্রহ হয়। মাছের আঁশ প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ খুব সহজ। মাছ থেকে আঁশ ছাড়িয়ে সেগুলোকে পরিষ্কার করে পানিতে ধুয়ে রোদ্রে শুকিয়ে বস্তায় প্যাকেট করে রাখতে হয়। সেখান থেকেই আঁশ চলে যায় ব্যবসায়ীর হাতে। শুরুর দিকে বাজার থেকে এই আঁশ প্রতি কেজি ১০থেকে ১৫ টাকা দরে সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল। বর্তমানে প্রতি কেজি ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রয় হচ্ছে।
বগুড়া থেকে আসা সংগ্রহকারীরা দুমাস পরপর আঁশ কিনে নিয়ে যায়। রফতানিকারক পর্যায়ে মাছের আঁশ পৌঁছাতে মাঠপর্যায়ের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাত, বাজারজাতকারীদের মধ্যে একটি নিবিড় নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেছে। পাশাপাশি এই আঁশ থেকে রূপান্তরিত পণ্য উৎপাদনের প্রবণতাও বাড়ছে। ফলে দেশে মাছের আঁশের চাহিদা ও দাম দুটোই বাড়ছে।
মাছের আঁশে আছে কোলাজেন ফাইবার, অ্যামাইনো এসিড, জেলাটিন, গুয়ানিন ও বায়ো অ্যাভসরবেন্স ক্যাপাসিটি ও-এর মতো কয়েকটি বিশেষ গুণ। বায়ো অ্যাবসরবেন্স ক্যাপাসিটি'র কারণে পরিবেশের অতিরিক্ত লেড এবং শিসা নিয়ন্ত্রণ করে। এই আঁশ দিয়ে তৈরি পাউডার ওষুধ শিল্প, প্রসাধনী শিল্প যেমন মহিলাদের গয়না, কানের দুল, গলার মালা প্রভৃতি তৈরি হয়। নেইল পলিশ ও লিপস্টিকের মূল উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয় মাছের আঁশ। এছাড়া খাদ্যশিল্প যেমন বিভিন্ন রকমের স্যুপে পুষ্টি উপাদান হিসেবে মাছের আঁশের পাউডার ব্যবহৃত হয়। মাছের আঁশে কোলাজেন থাকায় কৃত্রিম কর্ণিয়া ও কৃত্রিম হাড় তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। রিচার্জেবল ব্যাটারি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয় মাছের আঁশ। পোল্ট্রি খাদ্য হিসেবে মাছের আঁশ ব্যবহার করা হয়। মাছের আঁশ দিয়ে ওষুধের মোড়ক তৈরির কথাও জানা যায়। মাছের দেশ বাংলাদেশে এখন শুধু মাছ নয়, আঁশও দামি।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছের আঁশের রফতানি মূল্য ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় দুই কোটি ৯৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। পরবর্তী অর্থবছরেই অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৫ লাখ দুই হাজার ডলার বা চার কোটি ২৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি আয়ের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ ৯০ হাজার ডলার বা ২৬ কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়ে ৩০ কোটিতে পৌঁছায়। ক্রমশই মাছের আঁশ অর্থনীতিতে আলো ছড়াচ্ছে। ধীরে ধীরে প্রসার ঘটছে আঁশের। সেই সঙ্গে আসছে বৈদেশিক মুদ্রাও।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে মাছের চাহিদা ৪৫.৫২ লাখ মেট্রিক টন। এর ৪০ শতাংশের বহিরাবরণই আবৃত থাকে আঁশে। গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর ২০০ কোটি টাকার বেশি মাছের আঁশ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। শুধু চীনেই প্রতি বছর প্রায় তিন হাজার টন মাছের আঁশ রপ্তানি হচ্ছে। এটিও এখন একটি শিল্পে রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। অর্থাৎ এর একটি সম্ভাবনার বাজার তৈরি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শারমিন আকতার দৈনিক আজকের দর্পণ পত্রিকাকে বলেন, সরকারিভাবে এই শিল্পটিকে আরেকটু এগিয়ে নিতে পারলে বেকার সমস্যার সমাধান হওয়ার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিও লাভবান হতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানজিদা সুলতানা দৈনিক আজকের দর্পণ পত্রিকাকে বলেন, মৎস্য কর্মকর্তার মাধ্যমে আমরা মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের সচেষ্ট রয়েছি। মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের আঁশটের সংরক্ষণ বিষয়ে সাধ্যমত সহযোগিতা করছি।