
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদে ২৫টি বিভাগের মধ্যে সেশনজটের কারণে ১৮টি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা ৪৫তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করতে পারেনি। অন্যদিকে, সেশনজটমুক্ত হওয়ায় ৪টি বিভাগের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন। জানা যায়, উক্ত শিক্ষাবর্ষের ১৮টি বিভাগের এক হাজারের অধিক শিক্ষার্থী সেশনজটের কবলে পড়েছেন। এর মধ্যে কয়েকটি বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা চলমান। কেউ পরীক্ষার সময়সূচীর জন্য অপেক্ষা করছেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, সেশনজটের কারণে বিসিএস সহ অনেক সরকারি চাকরি থেকে পিছিয়ে পড়েছেন । মাত্র চারটি বিভাগ স্নাতক শেষ করতে পারলেও প্রশাসনের গাফিলতি ও দায়িত্বহীন আচরণের জন্য অন্যদের এমন সেশনজট তৈরি হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ৬টি বিভাগের মধ্যে ৫টি (সিএসই, গণিত, রসায়ন, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা ও পদার্থবিজ্ঞান) বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা সেশনজটের কারণে বিসিএসে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। অন্যদিকে, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হওয়া পরিসংখ্যান বিভাগে কোন জট নেই।
জীব বিজ্ঞান অনুষদের ৪টি বিভাগের মধ্যে দুইটি (কোস্টাল স্টাডিজ এন্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, প্রাণরসায়ন ও জৈবপ্রযুক্তি) বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। অন্যদিকে, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন।
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ৪টি বিভাগের প্রত্যেকটিতে জট রয়েছে। চারটি (মার্কেটিং, ম্যানেজম্যান্ট স্টাডিজ, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ফিন্যাস এন্ড ব্যাংকিং) বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ৬টি বিভাগের মধ্যে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ছাড়া ৪টি (অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও লোক প্রশাসন) বিভাগে সেশনজট রয়েছে। এই চারটি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। অন্যদিকে, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হওয়া সমাজকর্ম বিভাগের কোন ব্যাচ বের হয়নি।
কলা ও মানবিক অনুষদের চারটি বিভাগের দুটিতে জট রয়েছে। এ কারণে ইংরেজি ও বাংলা বিভাগের ১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বিসিএস আবেদন করতে পারেননি। এই অনুষদের শুধু দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থীরাই বিসিএস আবেদন করতে পেরেছেন। এবং ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে চালু হওয়া ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের কোন ব্যাচ বের হয়নি। আইন অনুষদের আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরাও সেশনজটের কারণে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা হলে তারা জানান, আমরা কাকে মনের ব্যথা বলব? সবাই আছেন রাজনীতি নিয়ে। তাদের কি সেশনজট নিয়ে ভাবনার সময় আছে?
তারা আরো বলেন, সংকট আর রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব শুধু বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়েই লেগেছে ৷ কিছু বললেই সংকটের কথা বলে। বলে আমরা নবীন বিশ্ববিদ্যালয়৷ সংকট নিয়েই কাজ করতে হবে। তাই আর কিছু বলতে চাই নাহ। এখন রেজাল্টের অপেক্ষায় আছি, বের হলেই সব ঝামেলা শেষ। দেড় বছর আমার জীবন থেকে বাড়তি নিয়েছে এর দায়ভার কে নিবে? আল্লাহ সইবে নাহ।
সেশনজট নিয়ে কয়েকটি অনুষদের ডিনদের সাথে কথা হয়। তারা জানান, সেশনজট সৃষ্টির মূলে কতগুলো সমস্যা রয়েছে যেমন শিক্ষক সংকট, শ্রেণিকক্ষ সংকট আর ল্যাব সংকট। বিভাগগুলোতে যে অনুপাতে শিক্ষক থাকার প্রয়োজন আসলে সেই অনুপাতে নেই। এজন্য একজন শিক্ষককে অনেকগুলো কোর্সের ক্লাস নিতে হয় যা কঠিন ব্যাপার। দ্বিতীয়ত ল্যাব সংকটের কারনে একটি ব্যাচকে তিন থেকে চারটি ভাগে ভাগ করে ল্যাব পরীক্ষা শেষ করতে হয় যার জন্য দেরি হয়ে যায়। আবার সেকেন্ড এক্সামিনার হিসেবে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে খাতা পাঠাতে হয়, অনেক সময় তারা খাতা দেরিতে পাঠান। পূর্ববর্তী সেমিস্টারের পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী সেমিস্টারের পরীক্ষা নিতে পারি না আমরা।
তারা আরো বলেন, আমরা শিক্ষকরা সবসময় শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিক কখনো একজন শিক্ষক চাননা কোন শিক্ষার্থী সেশনজটে পড়ুক। কিন্তু নানাবিধ নিয়ম আর সংকটে সেশনজটের সৃষ্টি হয়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, "বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এটি আরও গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে, কারন শিক্ষার্থীরা যতদ্রুত তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়োজিত করতে পারবে তাতেই আমাদের সাফল্য। আমরা আগামীতে বিসিএসসহ সকল ধরনের চাকরির পরীক্ষায় সময়মত শিক্ষার্থীরা যেন অংশগ্রহণ করতে পারে সেই বিষয়ে নানাবিধ কর্মপ্রয়াস গ্রহণ করব। লক্ষ্যনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে সেশনজটের বিষয়ে। একাডেমিক কাউন্সিল এবং ডিন ও চেয়ারম্যানদের মিটিংএ বিষয়টি যেন গুরুত্ব পায় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের সাথে এই বিষয়ে আমি আলোকপাত করব।"
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন বলেন, আমাদের মূল যে সেশনজটটি করোনাকালীন সময় থেকে শুরু হয়েছে। করোনাকালীন এবং এর আগের সেশনজট নিরসনে আমি আগে থেকেই ডিন এবং বিভাগের চেয়ারময়ানদের নির্দেশ দিয়েছি। এছাড়াও, একাডেমিক কাউন্সিল সভায় ডিন এবং বিভাগের চেয়ারম্যানদের সেশনজট নিরসনে আরো জড়ালো নির্দেশ দিব।
উল্লেখ্য, বিসিএস দিতে না পারার বিষয়ে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের নাম প্রকাশ করতে বলা হলে, একাডেমিক রেজাল্টে সমস্যা হওয়ার ভয়ে কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।