বিকেলের সোনা রোদে সিলেটের সবুজ গালিচা
চিকচিক করছিল। দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষের অপেক্ষায়। হঠাৎ-ই মাঠে শোনা গেল জোর গলার উচ্চ
হাসি। ফিল্ডিংয়ে থাকা বাংলাদেশ শিবিরের একজনকে ঘিরে আনন্দের হাসি। শরিফুল ইসলামের ক্রস
সিমের ভয়ংকর বাউন্সারে দিমুথ করুণারত্নে পুল করলেন। নিরাপদ শট। কিন্তু শরীরে ভারসাম্য
না থাকায় বল চলে যায় ফাইন লেগে। ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন নাহিদ রানা। বল ঠিকঠাক তালুবন্দি
করলেন।
বাংলাদেশ করুণারত্নের আউটে যতটা না খুশি
তারচেয়েও বেশি খুশি নাহিদ রানা বল তালুবন্দি করায়! কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে
টেস্ট শুরুর আগের দিনের চিত্র সামনে আনা জরুরী। প্রথমবার জাতীয় দলে ডাক পাওয়া নাহিদ
রানা বোলিংয়ের পর ফিল্ডিংয়ে নামলেন। তাকে একের পর এক ক্যাচ দিয়ে যাচ্ছিলেন কোচ। কিন্তু
বল জমাতেই পারছিলেন না। সংখ্যাটা এমন, ১০ বলে ৭-৮টি ক্যাচই ফেলে দিচ্ছেন। ২-৩টি ধরছেন।
মোটামুটি দলের ভেতরে চাওড় হয়েছে, ফিল্ডিংটা
নাহিদ রানার সিলেবাসের বাইরে! তাইতো করুণারত্নের ক্যাচ নেওয়ার পর বাংলাদেশ শিবিরে বাড়তি
উল্লাস। লিটন তো মাথায় হাত গিয়ে মুখ ভরা হাসি নিয়ে অবাক। পাশে থাকা মিরাজ, দিপুরাও
একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আনন্দ করছিলেন। ওই হাসি, ওই আনন্দ অবশ্য দিন শেষের স্কোরবোর্ড
দেখার পর টিকেছে কি না সেটা বিরাট প্রশ্ন। কেননা হাতে ৫ উইকেট নিয়েও শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয়
ইনিংসের লিড ২১১ রান। ব্যাটিং ব্যর্থতায় চড়ে বসেছে লঙ্কানরা তা বলতে দ্বিধা নেই।
শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংসে ২৮০ রানের জবাবে
বাংলাদেশ আজ ১৮৮ রানে অল আউট। ৯২ রানে এগিয়ে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে শ্রীলঙ্কা ৫ উইকেটে
১১৯ রানে দিন শেষ করেছে। তাতে স্বস্তির পরশ অতিথি শিবিরে। পিছিয়ে থেকে অস্বস্তিতে স্বাতিকেরা।
বাংলাদেশের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সকালের সেশনের ব্যাটিং। বিশেষ করে মাহমুদুল হাসান
জয় কিভাবে লঙ্কান আক্রমণ সামলে নেন তা ছিল দেখার। নাইটওয়াচম্যান তাইজুল টুকটাক ব্যাটিং
পারেন তা তো সবারই জানা।
দুই অপরাজিত ব্যাটসম্যান শুরুর আক্রমণ
সামলে নিয়েছিলেন। ৫ ওভারে কোনো বিপর্যয় হয়নি। এ সময়ে রান যোগ হয়েছে ২১। তাতে আশা বেড়েছিল।
কিন্তু ওই আশায় গুড়েবালি হতে সময় নেননি। তাইজুল যেখানে চূড়ান্ত মনোযোগ দেখিয়েছেন। থিতু
হয়ে উইকেটের মূল্য বুঝেছেন। সেখানে জয় উল্টোপথে হেঁটেছেন। পেসার লাহিরু কুমারার অফস্টাম্পের
অনেক বাইরের বল জায়গায় দাঁড়িয়ে ড্রাইভ করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন ১২ রানে।
এরপর কেবলই মন খারাপের গল্প।
পরীক্ষিত ব্যাটসম্যানরা ক্রিজে এসেছেন।
দুয়েকটি শট খেলেছেন। আউট হয়েছেন। আগের তিন ব্যাটসম্যান যা করেছেন শাহাদাত হোসেন দিপু,
লিটন দাশ, মেহেদী হাসান মিরাজ সেই পথেরই অনুসারী। টিকে থাকার তাড়না, লড়াই করার মানসিকতা,
দলকে এগিয়ে নেওয়ার জেদ চোখে পড়েনি। তাতে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। অল্পতেই অলআউট বাংলাদেশ।
শাহাদাত হোসেন দিপু লেগ সাইডে ফ্লিক ও
অফ সাইডে দারুণ এক স্ট্রেইট ড্রাইভে ভালো কিছুর আভাস দেন। কিন্ত লাহিরুর অফ স্টাম্পের
বাইরের বলে ব্যাট সরাতে পারেননি। লিটনও নিজের উইকেট বিলিয়ে এসেছেন আলগা মনোভাবে। লাহিরুর
ভেতরে ঢোকানো বলে ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়ে গিয়ে স্টাম্পে আঘাত করে। ৪৩ বলে ৪ বাউন্ডারিতে
২৫ রানে শেষ তার ইনিংস।
এই আসা-যাওয়ার মিছিলে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে
তাইজুল লড়াই করেন। তার একার লড়াইয়ে সঙ্গী পাননি কাউকে। তাই ঝুঁকি নিয়ে খেলতে হয়েছে
শট। তাতেই নেমে আসে বিপদ। দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৪৭ রান করা তাইজুল ৮০ বল খেলেন। বাউন্ডারি
পেয়েছেন ৬টি। আগের দিন ১০ মিনিট ব্যাটিং করা তাইজুল আজ মাটি কামড়ে ৭২ মিনিট টিকে ছিলেন।
৮২ মিনিটের লড়াই দিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলে গেছেন। পরীক্ষিত ব্যাটসম্যানরা কেন দায়সারা
ব্যাটিং করলেন? টেস্ট খেলার ধৈর্য্য কেন দেখালেন না?
শরিফুলের ১৫ ও খালেদের শেষের ২২ রানে বাংলাদেশের
লাভই হয়েছে। লিড নেমে এসেছে শতরানের নিচে। লিডের বোঝা মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয়
ইনিংসের বোলিংও ভালো হয়েছে। অভিষিক্তি নাহিদ রানা ১২ ওভারের ভেতরেই নিশান মাদুশঙ্কা
ও কুশল মেন্ডিসকে ফিরিয়ে দেন। দুই স্পিনার তাইজুল ও মিরাজও দায়িত্ব সামলে নেন ঠিকঠাক
মতো। তাইজুল ম্যাথুজসকে এবং মিরাজ চান্দিমালকে ড্রেসিংরুমের পথ দেখান।
এরপর শরিফুলের বাউন্সারে করুণারত্নে পড়ন্ত
বেলায় ফিরলে কিছুটা স্বস্তি ফেরে। কিন্তু লিডের বোঝা দুইশর বেশি চলে যাওয়াতে বিপদমুক্ত
নয় বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার চড়ে বসার আরেকটি দিনে ব্যাকফুটেই রয়েছে শান্তর দল। হাতে ৫
উইকেট রেখে তারা আর কতদূর যেতে পারে সেটিই দেখার।