বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে সাগর বক্ষে এ দ্বীপে টেকনাফ থেকে ট্রলারে, লঞ্চে কিংবা জাহাজে যেতে লাগে দুই থেকে সোয়া দুই ঘণ্টা। রূপ বৈচিত্র্যের অনন্য মহিমায় উদ্ভাসিত সেন্টমার্টিন দ্বীপে চমৎকার আবহাওয়া বিরাজ করে নবেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত।
এই সময়কে প্রধান ভ্রমণ ঋতু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বছরের বাকি সময় আবহাওয়া থাকে ভয়াবহ। সেন্টমার্টিনের স্বচ্ছ পানিতে জেলি ফিস, হরেক রকম সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ আর প্রবাল অন্যতম আকর্ষণ ও অপার সম্ভাবনা। এটিই বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। ১৯৫৮ সালে এক ভূত্তত্ব জরিপে দেখা গেছে এই দ্বীপে প্রায় ১০ লাখ টন প্রবাল রয়েছে। এই দ্বীপে জীবন্ত প্রবালের ৩৯টি প্রজাতি চিহ্নিত করা গেছে।
প্রাণের বৈচিত্র্য রয়েছে যে দ্বীপগুলোতে, তাকে টিকিয়ে রাখার মধ্যেই রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবি। সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও দ্বীপের চারদিকের জল এলাকার বিচিত্র প্রাণের সুরক্ষার মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশের পর্যটন ও মৎস্য আহরণ সম্ভাবনা। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেন্টমার্টিন কনজারভেশন প্রকল্পে মার্কিন কোরাল বায়োলজিস্ট টমাস, টমাসিকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সেন্টমার্টিনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৮৫০ জন পর্যটক পরিদর্শন করলে দ্বীপটির ক্ষতি হবে না। অথচ শীত মৌসুমে দিনে তিন থেকে চার হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাচ্ছেন, রাতে থাকছেন। একই সঙ্গে তারা চালিয়ে যাচ্ছেন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ।
জীবন-জীবিকা: প্রতি বছর সেন্টমার্টিনে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক আসা-যাওয়া করে। পর্যটকদের থাকার জন্য দ্বীপটিতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় ৮৮টি হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট। ১৯৭২ সালে যেখানে ১১২টি বসতি ছিল বর্তমানে সেখানে দেড় হাজার পরিবারের প্রায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ বসবাস করছে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্যরে পরিমাণ বাড়ছে। এখানকার মানুষ মূলত মৎস্য শিকার করেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। তবে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হওয়ায় অনেকেই রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল কিংবা গ্রোসারি শপের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। নারিকেল, পেঁয়াজ, মরিচ, টমেটো, এ দ্বীপের প্রধান কৃষিজাত পণ্য।
সেন্টমার্টিন হতে পারে ‘দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর’: সেন্টমার্টিন দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এই দ্বীপে প্রায় ২শ’ প্রজাতির জীবের উপস্থিতি রয়েছে বলে দাবি করেন বিজ্ঞানীরা। সমীক্ষা অনুযায়ী, দ্বীপটি চতুর্দিকে প্রবাল পাথরের বেষ্টনীতে গড়া। এর গভীরে রয়েছে জমাট বাঁধা পাথর। এই পাথরের বেষ্টনী সাগরের তলদেশ দিয়ে মালয়েশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে উঠা এই দ্বীপটিই হতে পারে পর্যটনের ক্ষেত্রে বিশ্বের ‘দ্বিতীয় সিঙ্গাপুর’। তবে এ জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত উন্নয়ন এবং সুষ্ঠু নীতিমালা। দ্বীপবাসীকে সম্পৃক্ত করে সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে এখানে পর্যটন শিল্প বিকাশে উদ্যোগ নেয়া হলে দ্বীপটি হয়ে উঠতে পারে বিশ্বের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র্র।
শৈবাল চাষের সম্ভাবনা: সেন্টমার্টিনে শৈবাল চাষের সম্ভাবনা রয়েছে। সামুদ্রিক বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নিশ্চিত করেছেন যে, সেন্টমার্টিনে ১৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল রয়েছে। যার অধিকাংশ মানুষের খাদ্যসহ হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সাধারণত চার ধরনের প্রবাল সংগ্রহ করা হয় যাদের স্থানীয় ভাষায় বলা হয় পাতা ফুল, গাছফুল, শৈবাল ও মগ। এদের মধ্যে গাছফুলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বাহারি অলঙ্কার প্রস্তুতের জন্যেই এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে প্রচুর চুনাপাথরসহ নানা প্রকার পাথর, রেডিয়াম, সামুদ্রিক শৈবাল, ঝিনুক, মুক্তা ও সিলিকন পাওয়া যায়। এছাড়া এই শৈবাল থেকে হ্যালোজেন জাতীয় উপাদান যেমন-ফ্লোরিন, ক্লোরিন, ব্রুমিন ও আয়োডিন এবং অন্যান্য মূল্যবান ধাতব পাওয়া যাবে। বৈজ্ঞানিকরা বলেছেন, সামুদ্রিক শৈবালে ঔষুধি গুণাগুণ রয়েছে। তাই এগুলো ওষুধ কারখানায় এবং জৈব সার তৈরিতে বিভিন্ন দেশে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। আশার খবর হলো- সেন্টমার্টিনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন হবে সামুদ্রিক শৈবাল ভা-ার। এখানকার চাষীরা শৈবাল চাষ ও বাণিজ্য করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হবেন। অপরদিকে এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা সম্ভব হবে।
মনোরম সৈকতের হাতছানি: সবুজ শ্যামল বৃক্ষ বেষ্টিত সাগর বুকে ভাসমান অনন্য শোভামণ্ডিত এই সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিনের উভয়প্রান্তে ছোট বড় ৩৭টি সৈকত রয়েছে যা ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে। সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে হবে আমাদের স্বার্থেই। সেজন্য সর্বসাধারণকে সচেতন থাকতে হবে পরিবেশ বিষয়ে। পর্যটন আইন মেনে চলতে হবে। ময়লা-আবর্জনা যত্রতত্র ফেলা যাবে না। স্থায়ী আবাসন কমাতে হবে। থাকার ব্যবস্থা বন্ধ করতে পারলে সবচেয়ে ভাল। পর্যটন পুলিশের সংখ্যা, বুথ ও নজরদারি বাড়াতে হবে। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।