মাত্র মাস তিনেক আগে গত অক্টোবরেও সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের সময়ে রাশিয়ার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তেলের উৎপাদন কমিয়ে দেয় সৌদি আরব, যা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য ছিল বড় ধরনের ধাক্কা। তার আগে জুলাইতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন জেদ্দায় গিয়ে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর অনুরোধ করলেও ক্ষমতাধর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান পাত্তা দেননি।
এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরবকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, সৌদিকে এর জন্য অনির্দিষ্ট ‘পরিণাম’ ভোগ করতে হবে। সম্পর্কের চরম অবনতির পর দুই দেশের কর্মকর্তারা একে অপরকে ছোটখাটো অপমানও করেন। তবে এ ঘটনার তিন মাস পরও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা দেখা যাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্রকে। শাস্তিহীন রয়ে গেছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কী ধরনের প্রতিশোধ নেওয়া হবে সে বিষয়ে বিশেষভাবে নীরব ছিলেন বাইডেন। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রস্তাবিত পদক্ষেপের বিষয়েও নীরব থেকেছেন বাইডেন। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা চলতি জানুয়ারির শুরুতে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছিলেন, সৌদি আরবের ওপর থেকে হুমকি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে গালফ স্টেট অ্যানালিটিক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জর্জিও ক্যাফিয়েরো বিজনেস ইনসাইডার সাময়িকীকে বলেছেন, সৌদিকে পরিণতি ভোগ করতে হবে- হোয়াইট হাউসের এমন হুমকি ম্লান হয়ে গেছে। এর একটি মূল কারণ, সৌদি আরব সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার কারণে তেলের দাম যে হারে বেড়ে যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, সেটা ঘটেনি। চীনে বোভিড প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশটির অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়ায় তেলের চাহিদা কমেছে। ফলে তেলের দাম আশঙ্কা অনুযায়ী বাড়েনি।
ক্যাফিয়েরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং সৌদি আরব উভয়ই অভিন্ন স্বার্থের দিকে মনোনিবেশ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো ইরানের হুমকি। ইরানের নিজস্ব ওয়ারহেড (ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরকমুখ) তৈরির ক্ষমতা সীমিত করার জন্য ২০১২ সালের পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বাইডেন প্রশাসন যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, দেশটি তা প্রত্যাখ্যান করেছে। এই ইসলামিক প্রজাতন্ত্র (ইরান) রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। রাশিয়াকে ড্রোন সরবরাহ করেছে যা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইউক্রেনের বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে। ইয়েমেনে ইরানের হয়ে (প্রক্সি) যুদ্ধ চালাচ্ছে হুথিরা। দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল এই সংঘাতে সৌদি আরব-সমর্থিত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে হুথিরা। হিজাব নিয়ে ইরানে চলমান দাঙ্গা ইয়েমেনের সংঘাতকে বাড়িয়ে তুলতে পারে বলেও যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।
ক্যাফিয়েরো বলেন, ইরানের পরিস্থিতি এখানে প্রাসঙ্গিক কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব উভয়েরই উদ্বেগ রয়েছে যে তেহরান তার অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাকে এমনভাবে আঞ্চলিক করার চেষ্টা করছে যা আশেপাশের দেশগুলোতে আঘাত করতে পারে। সৌদি আরবে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান- গত গত নভেম্বরে এমন একটি খবর প্রকাশ হলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানগুলো মহড়া দেয়, যা ইরানের আগ্রাসন প্রতিরোধে সহায়তা করার একটি পদক্ষেপ। পাশাপাশি সৌদি আরবকে বৃহত্তর নিরাপত্তা সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর সৌদি আরবের কাছে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি অনুমোদন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের কর্মকর্তারা বিজনেস ইনসাইডারকে বলেছেন, তারা একসঙ্গে তেহরানকে প্রতিহত করতে সংবেদনশীল গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান এবং সামরিক প্রকল্পে সহযোগিতা করছে। ইরানকে নিয়ে যৌথ পারস্পরিক স্বার্থ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে উত্তেজনা রয়েই গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে রিয়াদ। গত ডিসেম্বরের শুরুতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সাত বছর পর সৌদি আরব সফরে গেলে তাকে নিয়ে আরব বিশ্বের নেতাদের মধ্যে যে মাত্রার যে আগ্রহ-উচ্ছ্বাস দেখা গেছে তার নজির বিরল। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারসহ উপসাগরীয় সহযোগিতা জোট জিসিসির সব দেশের নেতারা প্রেসিডেন্ট শির সঙ্গে বৈঠকের জন্য রিয়াদে আসেন। হাজির হন মিশর, তিউনিসিয়া, লেবানন, ইরাক এবং সুদানের শীর্ষ নেতারাও। ওই সফরে দুই দেশের মধ্যে (চীন ও সৌদি আরব) নানা ক্ষেত্রে তিন হাজার কোটি ডলার মূল্যের ৩৪টি চুক্তি ও সমঝোতা চুক্তি হয়।
প্রেসিডেন্ট শির ওই সফর এবং তাকে নিয়ে সৌদি আরবসহ আরব নেতাদের এই মাতামাতি যুক্তরাষ্ট্রের যে একবারেই পছন্দ হয়নি তাতে সন্দেহ নেই। কারণ জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ উপসাগরীয় আরব অঞ্চলকে আমেরিকা বহুদিন ধরে তাদের প্রভাব বলয়ের অন্যতম মূল কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে এবং যে দেশের নেতাকে নিয়ে সেখানে এত উদ্দীপনা, সেই চীন বর্তমান বিশ্বে আমেরিকার এক নম্বর কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, বেশ কিছুদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে সৌদি আরব বা ইউএইর মধ্যে, নিরাপত্তা, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্য আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর তাগিদ দেখা যাচ্ছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং সৌদির অভ্যন্তরীণভাবে নির্মমভাবে ভিন্নমতকে যেভাবে দমন করছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, তা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যাপক ফাটল সৃষ্টি করতে পারে। তবে আপাতত দেশ দুটি অভিন্ন স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে এবং অভিন্ন স্বার্থের জন্য সৌদি আরবকে ছাড় দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই অভিন্ন স্বার্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্র আর কত ছাড় দেবে- সেটাই দেখার বিষয়।