শারদ সকালের সপ্তমী। স্কুলের পড়ায় মনে
নেই।মুখস্ত হচ্ছে না নামতা। তবে মণ্ডপে দুর্গাঠাকুরের চারপাশে কে কে দাঁড়িয়ে আছে, সেটা
আর কষ্ট করে মুখস্থ করতে হয়নি। এমনিতেই মুখস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে মনের মধ্যে।
এদিকে মণ্ডপের ঢাকঢোলে, ভাণ্ড সানাইয়ে
মুখর বাংলাভূমি। মুখর আমাদের চারপাশ। মুখর বাঙালির মন।
সাথে ধুপের গন্ধে শিশিরভেজা সকালটা হয়ে
উঠছে স্নিগ্ধ আর মায়াময় উৎসবের। চণ্ডীপাঠ শুনতে শুনতে শৈশবে যে ছবিটা মনে দাঁড়িয়ে যায়
সেই ছবিটি আর কোনোদিন বদলে যায়নি।
২.সিংহের পিঠে চড়ে দেবী মহিষের রূপধারণ
করা এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন।
এখন এই ছবিটি আরো স্পষ্ট। আকাশের তারার
মধ্যে মহিষাসুর বধের দৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দেখেছেন, রক্তবর্ণ বৃষের চোখ।
মুখোমুখি এক বিশাল আকারের সিংহ আর এক নারীমূর্তি। যার হাতের কাছাকাছি নানা অস্ত্র।
বিজ্ঞান খুঁজে পেয়েছে, পুরাণের কথাগুলো
নিছক গল্প নয়। সেই যুগের চিন্তাধারার সাথে যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দেখেছেন,
সিংহ আর মহিষদলের তারামণ্ডলী, যা দেখেই প্রাচীনকাল থেকে নানারূপে কল্পনা করা হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্বাব্দ তিনশ সময় নাগাদ সুমেরু
অঞ্চলের সিলমোহর ও একটি পাত্রের গায়ে যে ছবিটি বেশি দেখা যায়, সেটা একটি সিংহের হাতে
একটি মহিষের মৃত্যু। সন্ধ্যার আকাশে শেষবারের মতো তাকালে দেখা যায়, ‘সিংহ তারামণ্ডলী’। মনে হবে এই
সিংহটিই বৃষটিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মোট কথা, তারামণ্ডলীর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে
দেখা যাবে, সিংহের ওপর বসে দুর্গা মহিষাসুর বধের ছবিটি।
তারামণ্ডলী থেকে এই এক অসম্ভব রূপকল্পনা!
বাঙালির দশভূজার সঙ্গে মিল পেয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
কন্যা, সিংহ, বৃষসহ নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যেই দেবী দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী রূপের প্রতিচ্ছবি।
কৃষিভিত্তিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো চিহ্নিত করাই ছিল পুরাণের প্রথম প্রেরণা।
৩. প্রাণে আনন্দ জেগে ওঠা সকালে পুরোহিত
মহাশয় চলেছেন নদীর ঘাটে। কাঁধে নবপত্রিকা। নদী বা জলাশয়ে দেবীর প্রতীকরূপে নবপত্রিকাকে
স্নান করাবেন।
এই নবপত্রিকা নামটা শুনেলেই মনে মায়া জেগে
ওঠে। দুর্গাপূজা মহারম্ভের দিন, মানে সপ্তমীতে প্রকৃতির বৃক্ষ-লতার সাথে দেবী দুর্গা
একাত্ম হবেন আজ। সেজন্যই নবপত্রিকা দিয়ে মহারম্ভ, যা ‘ভেজিটেশন ডিইটি‘ হিসেবে দেবীর
‘প্রায়রিটি’ হয়ে দাঁড়ায়।
সপ্তমী হলো দুর্গাদেবীর সঙ্গে শস্যদেবীকে
মিলিয়ে নেবার সচেতন প্রচেষ্টা।
তাই, নদী বা জলাশয়ে নবপত্রিকাকে স্নানের
ভেতর দিয়ে দেবীকে জাগ্রত করা হয়। যার ভেতর দিয়ে ‘অবশেষ’ রচনা হয়ে যায়
ষষ্ঠী আর বোধনের।
৪. নবপত্র বা নবপত্রিকা মানে নয়টি গাছের
পাতা।
তবে পূজার নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, নয়টি
উদ্ভিদ। নয়টি উদ্ভিদ দেবীর নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীক। আবার নবপত্রিকা নয়জন প্রভাবশালী
দেব-দেবীকেও চিহ্নিত করে, বোঝায়।
কলা, কচু, মানকচু, হলুদ, জয়ন্তী, বেল,
ডালিম, অশোক ও ধান। এই নয়টির মধ্যে প্রধান উদ্ভিদ ‘কলাগাছ’, যা ‘ফার্টিলিটি’ আর ‘ভেজিটেশনের’ প্রতীক। দেবীর
সঙ্গে একাত্মতায় কলা গাছ বাঙালি মায়ের কোটি কোটি সন্তানের মা-প্রতীক হয়ে যান।
অন্য আটটি উদ্ভিদের সঙ্গে কচু। এটা মুখী
কচু। ফলন হয় ভাদ্রের শেষে আশ্বিনের শুরুতে। দরিদ্র মানুষের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়
কচুতে। আরেকটি মানকচু। বর্ষার পরে শরতের রোদে এটাও সুস্বাদু। ফলের মধ্যে আছে বেল আর
দাড়িম্ব।
বেলগাছ ও বেলপাতা শিব ও পার্বতীর প্রিয়তম।
স্বয়ং ব্রহ্মা দেবীর বোধন করেছিলেন বেলতলায়।
সেই প্রথা এখনো চলমান। যোগিনীতন্ত্রের
কাহিনীতে বলা হয়েছে, নারায়ণের অনেক স্ত্রীর মধ্যে থেকে প্রিয়তমা হওয়ার ইচ্ছায় বেলতলায়
শিবের আরাধনা করে শিবের সন্তুষ্টিতে নারায়ণের বক্ষলগ্না হয়েছিলেন লক্ষ্মী। তাই, শিবের
অধিষ্ঠান ক্ষেত্র এই বেলতলা। বেলের তিনপত্রের মধ্যে উপপত স্বয়ং শিবরূপে বন্দিত। সেজন্যই
শিব বেলপাতার পূজায় খুশি হন। বেলতলা শিবের প্রিয় হওয়ার কারণে শিবজায়া শিবানীরও খুব
প্রিয় এই স্থান। তাই, বেলতলায় দেবীদুর্গার বোধন।
আরো একটি কারণ মনে করিয়ে দেব।
বৈদিক যুগে কাঠে কাঠ ঘষে আগুন জ্বালানো
হতো, বলা হতো অরণী। শমী ও অশত্থ বৃক্ষের কাঠ ব্যবহার হতো অরণী রূপে। বাংলাভূমিতে শমীকাঠ
ছিল অত্যন্ত বিরল। এই কাঠের অভাব পূরণ করে বেল। মানে বেলকাঠে আগুনের অবস্থান। দেবী
দুর্গা যেহেতু স্বয়ং অগ্নিস্বরূপা সেজন্য দুর্গা আরাধনায় বেলবৃক্ষের অতি কদর।
পরের ফলটির নাম ‘দাড়িম্ব’, মানে ডালিম।
আশ্বিন থেকে অগ্রহায়ণ পর্যন্ত ফলন হয়। ফলটি শক্তি ও রক্তবর্ধক। একটা গাছে বহু জন্মায়।
পুষ্পবৃক্ষের মধ্যে আছে জয়ন্তী এবং অশোক।
দুটি বৃক্ষই মহৌষধ হিসেবে পরিচিত প্রচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে। জয়ন্তী বৃক্ষের নামটিই
তো দেবীর নামে রাখা। দেববৃক্ষ। জয়ন্তীর বীজ বহু ওষুধের উপাদান। শক্তি ও উত্তেজনা বাড়ানোর
পাশাপাশি নারীদের রোগ সারাতে জয়ন্তীর বহুগুণের কথা আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ধরা আছে।
জয়ন্তীর ফলন হয় আশ্বিনের শেষে।
এবার হলুদের কথা। হরিদ্রা বা হলুদ। কাঁচা
বা পাকা হলুদ খুবই দরকারি ভেষজ। সে কারণেই নবপত্রিকার অন্যতম উপকরণ হলুদ। আর, ধান হলো
লক্ষ্মীর প্রতীক।
জগতের সকল ওষধি ও উদ্ভিদের মাধ্যমে সকল
জীবকে আহার্য ও নিরাময় দান করেন।
নবপত্রিকা তারই প্রতীক বা প্রতিনিধি।
এই অতি দরকারি নয়টি ভেষজ এবং বৃক্ষ ভগবতী
দুর্গার নয়টি রূপ। ফল-ফুল অধিষ্ঠাত্রী দুর্গাকে প্রণাম জানানো হয়, ‘নবপত্রিকা বাসিন্যৈ
নবদুর্গায়ৈ নমঃ’।
নবপত্রিকা অনেকের মতে কুলবৃক্ষ নামেও পরিচিত।
‘শক্তানন্দ তরঙ্গিনী’ গ্রন্থ থেকে
জানতে পারি, যোগিনীরা সব সময় এই কুলবৃক্ষে বাস করেন। তন্ত্রশাস্ত্রে তাই একে ‘কল্পবৃক্ষ’ বলা হয়।
৫. সকাল থেকে মণ্ডপে মণ্ডপে পূজারীদের
ভক্তিপূর্ণ চলাচল।
ওদিকে পুরোহিত মহাশয়ের পেছনে হাঁটছেন বাদক
দল। ঢাকের শব্দে মিশে যাচ্ছে একদল নারীর শঙ্খ আর উলুধ্বনি। প্রথমে নদীতে শাস্ত্রবিধির
স্নান। এরপর চারা কলাগাছের সাথে আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একজোড়া বেলসহ শ্বেত অপরাজিতার
লতা বেঁধে দেবেন পুরোহিত মহাশয়। এরপর জড়ানো হবে লালপাড়ের সাদা শাড়ি। এমনভাবে জড়ানো
হবে, যেন চারা কলাগাছটা ঘোমটা দেওয়া বৌয়ের রূপ ধারণ করে। মানে, নবপত্রিকার হয়ে যাবে
কলাবৌ।
৬. নবপত্রিকা স্নানের পর মহাস্নান।
মহাস্নান মহাষ্টমী ও মহানবমীর দিনও মূল
অনুষ্ঠান শুরুর আগে অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিমার সামনে একটি আয়না রেখে সেই আয়নায় প্রতিফলিত
প্রতিমার প্রতিবিম্বে স্নান করানো হয়।
মহাস্নানে শুদ্ধজল, নদীর জল, শঙ্খজল, গঙ্গাজল,
উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, পঞ্চগব্য, কুশ ঘাসে ফোটানো জল, ফুল দিয়ে ফোটানো জল, ফলের জল,
মধু-দুধ-নারকেলের জল, আখের রস, তিলের তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি,
চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের
মাটি, গঙ্গামাটি, সব তীর্থের মাটি, সাগরের জল, ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টিজল, সরস্বতী নদীর
জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল ও ঝরনার জলে দুর্গাকে স্নান করানো হয়। এই মহাস্নানের মধ্য
দিয়ে সব ধরনের সম্পদের সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা চলে।
প্রার্থনা প্রকাশ পায় সর্বভূতে দেবীরই
অধিষ্ঠান। আর, মহাস্নানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে বিশ্বসংহতি ও অসাম্প্রদায়িকতার
সমন্বয়বার্তায় ফুটে ওঠে সমাজের কল্যাণ।
৭ . নদীর ঘাট থেকে চলে এসেছেন পুরোহিত
মহাশয়। এরইমধ্যে পৌঁছে গেছেন মণ্ডপে।
কলাবৌয়ের কপালে তেল-সিঁদুর দিয়ে প্রকট
করা হয়েছ এয়োতির চিহ্ন। এবার নবপত্রিকাকে দেবীর ডান দিকে আর গণেশ ঠাকুরের বাম পাশে
বসিয়ে দেন কাঠের আসনে।
তখনই গজ-নিমিলিত চোখে গণেশ ঠাকুর ভাবলেন,
মায়াবতী মা নিশ্চয়ই আমার জন্যে বৌ খুঁজে এনেছেন। গণেশ ঠাকুরের এই ধারণা স্পষ্ট হয় কলাবৌকে
তাঁর বাম দিকে রাখার কারণে। বাম দিকেই স্ত্রীর অবস্থান, ‘বামাবতী’।
আবেগপ্রবণ বাঙালির কাছে তাই নবপত্রিকার
চারাকলাগাছটি হয়ে যায় গণেশ ঠাকুরের বৌ।
তাই হয়তো নাতি-পুতির মুখ দেখার আশায় শঙ্কর-মহাদেব
স্ত্রী দুর্গাকে একসময় বলেই ফেললেন, ‘ও গণেশের মা,
কলাবৌকে দাগা দিও না। ওর একটি মোচা ফললে পরে, অনেক হবে ছানাপোনা’।