একবার নবীজি
(সা.) সাহাবীদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি জানো নিঃস্ব কে? তারা বললেন, যার অর্থ-সম্পদ
নেই আমরা তো তাকেই নিঃস্ব মনে করি। তখন নবীজি (সা.) বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে নিঃস্ব
সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের ময়দানে নামাজ, রোজা, জাকাতসহ (অনেক নেক আমল) নিয়ে হাজির হবে।
তবে সে হয়ত কাউকে গালি দিয়েছে বা কারো উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে বা কারো সম্পদ আত্মসাৎ
করেছে বা কাউকে খুন করেছে অথবা কাউকে আঘাত করেছে। ফলে প্রত্যেককে তার হক অনুযায়ী এই
ব্যক্তির নেক আমল থেকে দিয়ে দেয়া হবে। যদি কারও হক বাকি থেকে যায় আর এই ব্যক্তির নেক
আমল শেষ হয়ে যায়, তাহলে হকদার ব্যক্তির পাপ পাওনা অনুসারে এই ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে
দেয়া হবে। ফলে সে এই পাপের বোঝা নিয়ে জাহান্নামে যাবে। (সহীহ মুসলিম, হাদিস ২৫৮১; জামে
তিরমিজি, হাদিস ২৪১৮)
হযরত আব্দুল্লাহ
ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, কিয়ামতের ময়দানে কোনো বান্দা
তার এক পাও নড়াতে পারবে না। যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে- ১. সে তার জীবন
কোন পথে শেষ করেছে। ২. যতটুকু ইলম শিখেছে তার উপর কতটুকু আমল করেছে। ৩. সম্পদ কোন পথে
আয় করেছে। ৪. এবং কোন পথে ব্যয় করেছে। ৫. নিজের যৌবনকে কোন পথে শেষ করেছে। (জামে তিরমিযী,
হাদিস ২৪১৭)
অন্যের অবৈধ সম্পদ
ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কঠোরতা
কোনো মুমিন নিজে
তো অস্বচ্ছ ও অবৈধভাবে সম্পদ উপার্জন করবেই না। এমনকি অন্যের অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদও
সে ব্যবহার করবে না।
হযরত আবু হুরাইরা
(রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জেনেশুনে
চুরি করে আনা মাল ক্রয় করল, সেও চুরির পাপের মধ্যে শামিল হল।’ (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদিস ২২৫৩)
লেনদেনে অস্বচ্ছতার
কারণে দুআ-ইবাদত কবুল হয় না
আমরা নামাজ-রোজাসহ
অন্যান্য ইবাদত পালন করি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আর তিনি সেই আমলের দ্বারাই
সন্তুষ্ট হন, যে আমল তার কাছে গ্রহণযোগ্য। যে ব্যক্তি অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ থেকে
তার প্রয়োজন পুরা করে; আল্লাহ পাক তার ইবাদত-বন্দেগী ও দুআ-মুনাজাত কবুল করেন না। হাদিস
শরীফে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ
পবিত্র। তিনি পবিত্র (আমল) ছাড়া গ্রহণ করেন না। তিনি রাসূলগণকে যে আদেশ করেছেন। একই
আদেশ করেছেন মুমিনদেরকে। তিনি বলেছেন- (হে রাসূলগণ! আপনারা উত্তম (হালাল) রিযিক থেকে
আহার করুন এবং নেক আমল করুন।
তিনি মুমিনদেরকেও
বলেছেন- হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার প্রদত্ত হালাল রিযিক থেকে আহার কর। অতপর নবীজি একজন
লোকের বর্ণনা দিলেন যে ,দীর্ঘ সফর করেছে। চুলগুলো এলোমেলো, শরীর ধূলি ধূসরিত। আসমানের
দিকে হাত উত্তোলন করে দুআ করছে- হে আমার রব! হে আমার রব!! অথচ তার খাদ্য-পানীয় হারাম,
পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম; তাহলে কীভাবে তার দুআ কবুল হবে? (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১০১৫; জামে
তিরমিজি, হাদিস ২৯৮৯)
ইবনে রজব হান্বলী
রাহ. হাদিসটির ব্যাখ্যায় লিখেছেন, এই হাদিসে উদাহরণস্বরূপ শুধু দুআর বিষয়টি উল্লেখ
করা হয়েছে। নতুবা হারাম দ্বারা প্রতিপালিত হলে তার কোনো আমলই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে
না। (জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, পৃ. ১৮৫)
আল্লাহ তায়ালা
অবৈধ সম্পদের দান কবুল করেন না
ইসলামের সুস্পষ্ট
ঘোষণা হচ্ছে, কেবলমাত্র নেক আমলই বদ আমলকে নির্মূল করে। বদ আমল কখনো অন্য বদ আমলকে
নির্মূল করতে পারে না। অর্থাৎ আমরা দান-সদকা, জাকাত-ফিতরা আদায় করি, যাতে আমাদের পাপ
মোচন হয় এবং সম্পদ পবিত্র হয়। কিন্তু এ কাজ পাপের পথে অর্জিত সম্পদ দ্বারা সম্ভব নয়।
কারণ অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করাই একটি পাপ। সুতরাং সেই পাপ দ্বারা অন্য পাপ মাফ হওয়ার
আশা নেই। তেমনই অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ অপবিত্র, সুতরাং তা দ্বারা নিজের সম্পদ পবিত্র
করাও অসম্ভব। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘এমন হবে না যে,
কোনো বান্দা হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করবে অতপর তা থেকে (বৈধ ও নেক কাজে ) খরচ করবে
আর তাতে বরকত দান করা হবে। সে তা থেকে সদকা করবে আর তা কবুল করা হবে। বরং ঐ ব্যক্তি
ঐ সম্পদ (মিরাছ হিসাবে) তার মৃত্যুর পর রেখে গেলেও তা তাকে আরো বেশি করে জাহান্নামে
নিয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা পাপ দ্বারা অপর পাপকে নির্মূল করেন না। তবে নেক আমল
দ্বারা পাপকে নির্মূল করেন। নিশ্চয়ই নাপাক বস্তু অপর নাপাক বস্তুর নাপাকি দূর করতে
পারে না।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৩৬৭২; মুসনাদে
বায্যার, হাদিস ২০২৬)
হাদিস শরীফে রাসূল
(সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ পাক পবিত্রতা ব্যতীত নামাজ কবুল
করেন না এবং আত্মসাতের মালের ছদকা কবুল করেন না।’ (সহিহ মুসলিম,
হাদিস ২২৪)
এর বিপরীতে হালাল
ও বৈধ সম্পদ সদকা করার ব্যাপারে নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ পাক কেবল
(হারামের মিশ্রণ থেকে) পবিত্র বস্তুই কবুল করেন। যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে এক
মুষ্ঠি খেজুরও দান করে আল্লাহ পাক তা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর তা ওই ব্যক্তির জন্য প্রতিপালন করতে থাকেন। যেমন তোমাদের
কেউ উটের বাচ্চা প্রতিপালন করে। বৃদ্ধি পেতে পেতে এক সময় ওই সামান্য খেজুরমুষ্ঠি পাহাড়সম
হয়ে যায়। (সহিহ বুখারী, হাদিস ১৪১০; সহিহ মুসলিম, হাদিস ১০১৪)
হযরত আবু হুরাইরা
(রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন তুমি তোমার
সম্পদের জাকাত আদায় করলে তখন তুমি এ সম্পদের ব্যাপারে তোমার অবশ্যকরণীয় বিধান পালন
করলে। যে ব্যক্তি হারাম মাল উপার্জন করবে অতপর তা সদকা করবে সেই সদকায় তার কোনো সওয়াব
হবে না বরং অবৈধ উপার্জনের পাপের বোঝা তার ঘাড়ে চেপেই থাকবে।’ (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩২১৬) তাবেঈ
কাসেম বিন মুখায়মিরাহ রাহ. (সাহাবীর মধ্যস্থতা উল্লেখ না করে সরাসরি রাসুলের থেকে)
যেসকল হাদিস বর্ণনা করেছেন তার একটি হল, নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো
পাপের পথে সম্পদ উপার্জন করল অতপর তা আত্মীয়তা রক্ষায় খরচ করল বা সদকা করল অথবা তা
আল্লাহর রাস্তায় খরচ করল; তাহলে (কিয়ামতের মাঠে) এসবকিছুই একত্রিত করা হবে অতপর তা
জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। (কিতাবুল মারাসীল, আবু দাউদ, হাদিস ১৩১)
বিখ্যাত সাহাবী
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে একবার জিজ্ঞাসা করা হলো, যে ব্যক্তি এখন নেক আমল করছে।
তবে পূর্বে জুলুম-অত্যাচার করত এবং হারাম গ্রহণ করত। এখন সে নেকদিলে তওবা করে পূর্বের
সেই সম্পদ দিয়ে হজ্ব করল, গোলাম আযাদ করল এবং আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা করল (তার ব্যাপারে
কী বলেন?)। জবাবে তিনি বললেন, নিশ্চয়ই নাপাকী অপর নাপাকীকে দূর করতে পারে না। (মুসনাদে
বায্যার, হাদিস ৯৩২)
সুতরাং যারা হারাম
পথে সম্পদ উপার্জন করে আর মনে মনে ভাবে, এখান থেকে কিছু সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান
করে দেব; ব্যস, সাত খুন মাফ, তাদের উচিত, নবীজি
(সা.) এর এই বাণীগুলো ভালোভাবে স্মরণ রাখা।
এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ
ইবনে ওমর রা. এর একটি বড় শিক্ষণীয় ঘটনা আছে। তার সময়ে বসরার আমির ছিল আব্দুল্লাহ বিন
আমের। সে মুসলমানদের বায়তুল মাল থেকে তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশি গ্রহণ করত। কিন্তু তার
স্বভাব ছিল, সে এসব সম্পদ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিত, মসজিদ নির্মাণের কাজে খরচ করত,
বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করত। যখন সে মৃত্যুশয্যায় উপনীত হল তখন লোকজন তার চারপাশে
ভীড় জমাল এবং তার দান-দাক্ষিণ্য ও মানুষের প্রতি তার অনুগ্রহের ভূয়সী প্রশংসা করতে
লাগল। তবে ইবনে ওমর রা. চুপচাপ রইলেন। যখন বসরার আমির ইবনে আমের স্বয়ং তাকে কথা বলতে
ও নিজের জন্য দুআ করতে আবেদন করল।
তখন তিনি তাকে
নবীজি (সা.) এর একটি হাদীস শোনালেন-‘আল্লাহ পাক আত্মসাতের
মালের ছদকা কবুল করেন না। অতপর তাকে বললেন, তুমি তো বসরা শহরেরই আমির ছিলে। অর্থাৎ
আমি তোমার কীর্তি-কর্ম সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত যে, তুমি বায়তুল মালের সম্পদ না-হকভাবে
গ্রহণ করতে। সুতরাং কীভাবে তোমার এসকল দান-সদকা কবুল হবে? আর তোমার জন্যে দুআ করলে
সেই দুআই বা কীভাবে কবুল হবে?’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৪)
হারাম হতে সৃষ্ট
শরীর জান্নাতে যাবে না
হযরত জাবির রা.
থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন-‘এমন শরীর কখনো
জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যা হারাম দ্বারা বর্ধিত। জাহান্নামই তার উপযুক্ত স্থান।’ -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৪৪১; মুসান্নাফে
আব্দুর রায্যাক, হাদীস ২০৭১৯; মুসনাদে আবদ ইবনে হুমাইদ, হাদীস ১১৩৮
নবীজী (সা.) একবার
হযরত কা‘ব বিন উজরাহ রা.-কে ডেকে বললেন, হে কা‘ব! শুনে রাখো, ওই দেহ জান্নাতে প্রবেশ
করবে না, যা হারাম হতে সৃষ্ট। কেননা জাহান্নামের আগুনই তার অধিক উপযোগী।-জামে তিরমিযী,
হাদীস ৬১৪; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, ১৯/২১২