
গতবছরের ২৭ জুলাই ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বাচোর ইউনিয়ন নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে ভাংবাড়ি ভিএফ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণার পর মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়েছিলো।
পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ২ রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৪ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। ওই সময় কেন্দ্রের পাশে ভাংবাড়ি বেল মার্কেটের সামনে ৮মাস বয়সী সুরাইয়া আক্তারকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মা মিনারা বেগম। সেই গুলির আঘাতে ছোট্ট সুরাইয়া মায়ের কোলেই মারা যায়।
এসময় বিক্ষুব্ধ জনতা প্রিজাইডিং অফিসারসহ পুলিশ সদস্যদের অবরুদ্ধ করে রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে চলাচল বন্ধ করে দেয়। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। নিহত শিশুর মরদেহ নিয়ে পরিবার ও এলাকাবাসী রাণীশংকৈল থানা ঘেড়াও করে।
ওই দিন রাতেই জেলা প্রশাসক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রটকে আহবায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। আর নিহত সুরাইয়া'র মায়ের হাতে তুলে দেয়া হয় নগদ ৫০ হাজার টাকা। পর দিন বিকেলে দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত শিশুটির ময়নাতদন্ত শেষে নিজ কাঁধে সন্তানের মরদেহ বহন করে দাফন করেছেন ফেরিওয়ালাবাবা মো. বাদশা মিয়া। নির্বাচনের পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় থানায় পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে আসামী করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ৮০০ জনের বিরুদ্ধে।
ঘটনার ২দিন পর বুলেট বা ভারী বস্তুর আঘাতে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, শিশুটির মাথায় আঘাত ছিলো। এটি লোহার রডের আঘাতেও হতে পারে, বুলেটের আঘাতেও হতে পারে। খুলির একটি অংশ পাওয়া যায়নি।
নিহতের বাবা বাদশা মিয়া জানান, নিষ্পাপ শিশুটি কী অন্যায় করেছে যে তাকে প্রাণ হারাতে হলো। এই হত্যার বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি। তিনি আরো বলেন, ওই সময় অনেকে অনেক সান্তনা আর প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে আর কেউ খোঁজ রাখেনি তার পরিবারের। নির্বাচনের কথা আসলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে মেয়ের মাথার খুলি উড়ে যাওয়া বীভৎস মৃত মুখ। তাই ভোট নিয়ে আর কোনো আগ্রহ নেই তার।
ওই সময় জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর হোসেন (অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) বলেছিলেন, ভোটের ফল ঘোষণা শেষে কেন্দ্র ত্যাগ করার সময় পরাজিত মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকরা পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। তিনি এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি তখন।
এরপর কেটে যায় এক বছরেরও বেশি সময়। সন্তান হারিয়ে শোকে কাতর সুরাইয়া আক্তারের বাবাকে আশ্বাসের অংশ হিসেবে দুটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি, চিকিৎসার খরচসহ পরিবারটিকে নানা রকম সহায়তার কথা বলা হয়। কিন্তু বাদশার অভিযোগ, একটি ঘর পেলেও আরেকটি ঘরের জন্য ধরনা দিয়েও ঘর পাননি তিনি। তার চিকিৎসার ওষুধ পত্রের সহায়তার কথা বললেও, তা দেয়া হয়নি তাকে। এমনকি পরে কোনো খোঁজও নেয়া হয়নি পরিবারটির।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন জানতে চাইলে বাদশা বলেন, ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেছি। ভোট কেন্দ্রে কোনো নিরাপত্তা নাই। আবারও গুলি চলবে না, আমার মাথার খুলি উড়বে না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এর আগে ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর নির্বাচনী সহিংসতায় জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) গুলিতে ৩জন নিহত হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। নিহতরা হলেন, পীরগঞ্জ উপজেলার ঘিডোব গ্রামের আদিত্য কুমার রায়, হাবিবপুর গ্রামের মো. সাহাবুলি ও ছিট ঘিডোব গ্রামের মোজাহারুল ইসলাম। এ ছাড়াও নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনায় আহত হয়েছেন একাধিক নারী পুরূষ। স্বজন হারানো এসব এসব মানুষগুলোর কাছে নির্বাচন যেন এক আতঙ্কের নাম।
ভোট কেন্দ্র্রে প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছেন ঠাকুরগাঁওয়ের এক কলেজ শিক্ষক। তিনি বলেন, ভোট কেন্দ্রে আমরা যারা প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসাররা দায়িত্ব পালন করি, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় শঙ্কায় থাকি। ভোট কেন্দ্রের ভেতরে ও বাহিরে যারা দায়িত্ব পালন করেন সবারই নিরাপত্তা জোরদার করা দরকার।
এছাড়াও একই বছরের ২৭ ডিসেম্বরে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নে নির্বাচনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন স্থানীয় হামিদুর রহমান। ওই সময় এসপি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছিলেন, মেম্বার প্রার্থীর নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে দ্বন্দের জেরে সরকারি কাজে বাধা দেয় একটি পক্ষ। সেখানে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার নির্দেশে পুলিশের গুলিতে একজন মারা গেছেন।
সম্প্রতি নির্বাচন নিয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে নিহত হামিদুর রহমানের ছেলে হাসিবুল ইসলাম জানান, সেদিন আমার বাবা ভোট কেন্দ্রের পাশে বাজারে অবস্থান করছিল। বিকেলে কেন্দ্রে ফলাফল নিয়ে উত্তেজনা ছড়ালে পুলিশ গুলি চালায়, আমার বাবা নিহত হন। নির্বাচনী সহিংসতায় বাবাকে হারিয়েছি, বিচার চাইনি। কার কাছে বিচার চাইব?
এ বিষয়ে কথা হয় সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় ভোট কেন্দ্র কেন এত সহিংসতা প্রবণ ও এর থেকে উত্তোরণের উপায় কী? তারা বলেন, নির্বাচন এলেই দেখা যায় ভোট কেন্দ্রগুলো কোনো রাজনৈতিক দলের দখলে থাকে। তখন সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে বা স্বাধীন মতামত দিতে ভয় পায়। এর জন্য নির্বাচন কমিশনের যেভাবে নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন, সে ধরনের নিরাপত্তা ভোট কেন্দ্রগুলোতে দেখা যায় না।
তারা আরো বলেন, এ ছাড়াও ফলাফলকে কেন্দ্র করে কোনো পক্ষ পেশিশক্তি প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। এ জন্য নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটে আর প্রাণ হারায় নিরীহ সাধারণ মানুষ। তাই সাধারণ মানুষ ভোট দেয়ার সাহসটুকু হারিয়ে ফেলেছে। কাজেই নির্বাচনী সহিংসতায় যেসব মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং মানুষ যে এখন ভোট দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছে এর দায় নির্বাচন কমিশন কোনোমতে এড়াতে পারে না।