দক্ষিণাঞ্চলের প্রান্তিক জেলা বাগেরহাটের মানুষের জীবিকার প্রধান মাধ্যম কৃষিকাজ। তবে কৃষিনির্ভর জীবিকার এ জেলায় আজীবনই উপেক্ষিত কৃষকরা। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য আর সিন্ডিকেটের প্রভাবে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন তারা। তাই রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে উৎপাদিত ফসল বিক্রির সময় হাসির বদলে মুখটা মলিন থাকে তাদের। অনেকটা লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার মতো অবস্থা। বাগেরহাটের হাজারো চাষি আর কৃষকের জীবনের নির্মম বাস্তবতা এটিই। কৃষক পর্যায় থেকে খুচরা বাজারে আসতে কৃষি পণ্য কয়েক হাত বদল হয়। এতে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম তিন-চার গুণ বেড়ে যায়। ফলে লাভের সব টাকা চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে।
তবে কৃষকদের সেই কষ্ট আর গুমরে ওঠা কান্নার বাস্তবতা অতীত হতে চলেছে। উদ্বোধন হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় স্থাপনা স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু দিয়ে উৎপাদিত কৃষিপণ্য, সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ সহজেই ঢাকার বাজারে নিয়ে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন বাগেরহাটের কৃষক-চাষিরা। এতে একদিকে যেমন লাভবান হবেন তারা, অন্যদিকে পণ্য নষ্ট হওয়ার শঙ্কা কমে যাবে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার সাদুল্লাহপুর গ্রামের চাষি শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনটি ঘেরে গত বছর লাউ, ঢেঁড়স, মিষ্টি কুমড়াসহ কয়েক প্রকার সবজির চাষ করি। উৎপাদনও ভালো হয়। কিন্তু দেড় লাখ টাকা খরচে লাভ হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। অথচ এই সবজি স্থানীয় ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি না করে যদি ঢাকায় পাঠাতে পারতাম, তাহলে লক্ষাধিক টাকা লাভ হতো। পদ্মা সেতু চালুর খবরে ইতোমধ্যে ঢাকার এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি সরাসরি সবজি নেবেন বলে কথা দিয়েছেন। খানপুর এলাকার গাউস মল্লিক ১০ বিঘা জমিতে বর্ষাকালীন বিভিন্ন সবজি চাষ করছেন দুই দশক ধরে। তিনি বলেন, সিন্ডিকেটের কারণে উৎপাদিত সবজি কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হই আমরা। এখন পদ্মা সেতুর ফলে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে যাবে। তবে সিন্ডিকেট ও ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য কমাতে প্রশাসনের সহযোগিতাও প্রয়োজন।
জেলার কচুয়া উপজেলার গজালিয়া এলাকার সবজি চাষি আব্দুল হাকিম শেখ বলেন, শীতকালীন সবজির জন্য এ অঞ্চল প্রসিদ্ধ। আগে নদীর পাড়ে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে আমরা ঢাকার বাজারে সময়মতো কৃষিপণ্য পৌঁছাতে পারতাম না। পথেই অনেক পণ্য নষ্ট হয়ে যেত। তাই স্থানীয় বাজারে বা ফড়িয়াদের কাছে কম দামে বিক্রি করতে হতো। এখন সেতু দিয়ে সহজেই আমরা গাড়ি ভাড়া করে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় সবজি পাঠাতে পারব। এছাড়া ঢাকা থেকে ব্যবসায়ীরা বাগেরহাটে এসে সবজি কিনতে পারবেন।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাগেরহাটে কৃষক পরিবার রয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ৩২৮টি। চলতি অর্থবছরে জেলায় ধান উৎপাদন হয়েছে ৬ লাখ ৯০ হাজার ৭২০ মেট্রিক টন। সবজি উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। বাগেরহাটের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আজিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন কৃষকরা। বাগেরহাট থেকে বছরে অন্তত ৭০ হাজার মেট্রিক টন সবজি ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় যায়। সেতুর ফলে কম খরচে, অল্প সময়ে এই কৃষিপণ্য পৌঁছে যাবে সর্বত্র। জেলার কৃষি বাণিজ্যিকীকরণে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হতে চলেছে।
সরেজমিনে বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াপাড়া, ডেমা, কাশিমপুর এলাকার একাধিক মৎস্যচাষির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিংড়ি ও কার্পু জাতীয় মাছসহ (রুই, কাতলা, মৃগেল, টেংরা, পারসে, বেলে, তেলাপিয়া, পাতাড়ি) উৎপাদিত মাছের বড় অংশের বাজার ঢাকা ও এর আশপাশের জেলা। দূরবর্তী জায়গা হওয়ায় প্রাথমিকভাবে স্থানীয় ফড়িয়া ও আড়তদারদের কাছে মাছ বিক্রি করে দিতে হয়। এতে খুব একটা লাভবান হতে পারেন না প্রান্তিক চাষিরা।
স্থানীয় চাষিরা সরাসরি ঢাকার বাজার ধরতে না পারার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন ফেরি পারাপারজনিত সংকটকে। সময় মতো ফেরি না পাওয়ায় পদ্মা নদীর পাড়েই তাদের কাটাতে হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার চাইলেও প্রক্রিয়াজাত করে মাছ নিয়ে ঢাকায় যেতে পারেন না দরিদ্র চাষিরা। তবে পদ্মা সেতু দিয়ে বাগেরহাট থেকে ঢাকায় যেতে সময় লাগবে মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। ফলে ঢাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চাষিরা সরাসরি ঘের থেকেই মাছ গাড়িতে করে ঢাকায় পাঠাতে পারবেন।
তিন যুগের বেশি সময় ধরে মিশ্র চিংড়ি (বাগদা, গলদা) ও সাদা মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত কাড়াপাড়া এলাকার মানিক শিকদার। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে আমাদের অনেক লাভ হবে। আগে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার দিয়ে চিংড়ির রেনু পোনা এসে মাওয়া ফেরিঘাটে ১৫-২০ ঘণ্টা অপেক্ষা করত। ঘের পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক পোনা মারাও যেত। তবে এখন আর আমাদের সেই সমস্যায় পড়তে হবে না।
মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, জেলায় ৬৬ হাজার ৭১৩ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৬৮৫টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। জেলায় চাষি রয়েছেন প্রায় ৫৬ হাজার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সাড়ে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজার মেট্রিক টনে। টাকার অংকে বাজার মূল্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এই সময়ে সাদা মাছ উৎপাদন হয়েছে ৬০ হাজার মেট্রিক টন। টাকার অংকে মূল্য ১৪ হাজার কোটি টাকা।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, বাগেরহাটের স্থানীয় চাষিরা পুকুর-ঘের থেকে যে মাছ ফজরের সময় ধরবেন, সকাল ১০টার মধ্যে সেই মাছ পাওয়া যাবে ঢাকার বাজারে। এতে চাষি যেমন লাভবান হবেন, তেমনি রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ভোক্তারা টাটকা মাছ পাবেন। বাগেরহাটের মাছের বড় অংশের ক্রেতা রাজধানী শহরের মানুষ। এখন থেকে চাষিরা সহজেই মাছ ঢাকার বাজারে পাঠাতে পারবেন। এর মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমে যাবে।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মধ্যে বাগেরহাট সবচেয়ে বেশি উন্নত হবে। অর্থনৈতিকভাবে এ জেলায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হলো। কৃষকরা যেমন ন্যায্যমূল্য পাবেন, তেমনি তাজা ও টাটকা কৃষিপণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে দেশের অন্য জেলায়। পাশাপাশি পর্যটন ও বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।