কয়েক দশক ধরেই
উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ডের প্রদেশের থাম ফা মাক মন্দির রেসাস ম্যাকাউ বানরদের বিচরণ
ও বসতির জন্য বিখ্যাত। প্রতিদিন সকালে মন্দিরের ভিক্ষুরা ভাত ও ফল-মূল খেতে দেন তাদের।
পর্যটকেরাও আশপাশের দোকান থেকে কলাসহ নানান কিছু কিনে খাওয়ান এ বানরদের
গার্ডিয়ানের
এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত কয়েক মাস ধরে স্থানীয় বাসিন্দারা খাবার নিয়ে এসে আবিষ্কার
করছেন তাঁদের স্বাগত জানাতে কমসংখ্যক বানর উপস্থিত হচ্ছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর
দাবি লোয়েই প্রদেশের ওই মন্দির থেকে সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকশ বানর অদৃশ্য হয়ে গেছে।
বিষয়টি তদন্ত
করে দেখা হচ্ছে বলে জানান ওয়াংসফাং জেলার চিফ অফিসার প্রাচা সায়েনক্ল্যাং। একটি সম্ভাবনা
হলো, ঋতু পরিবর্তন কিংবা কোভিড পরিস্থিতির কারণে বিগত সময়ে কমসংখ্যক পর্যটক খাবার নিয়ে
এসেছেন। এতে বানরেরা জায়গা পরিবর্তন করে অন্য কোথাও চলে গেছে।
তবে কেউ কেউ
আবার বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের হাত থাকার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। ওয়াইল্ডলাইফ ফাউন্ডেশন
অব থাইল্যান্ডের (ডব্লিউএফএফটি) প্রতিষ্ঠাতা এডউইন উইক বলেন বানরগুলোকে ধরে সীমান্তের
ওপাশে পাচার করা হতে পারে। ‘লাউসের কিছু খামারে এ ধরনের বানরগুলোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’ বলেন তিনি।
কোভিডের পর
থেকে এই অঞ্চলে বানর পাচার, বিশেষ করে লং-টেইলড বা লম্বা লেজী ম্যাকাউ বানর পাচার একটা
দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালের মার্চে চীন ম্যাকাউ বানর রপ্তানি বন্ধ
করে দেয়। এতে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাগারে বানরের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। আর এই সংকটের
কারণে চোরাচালান বেড়ে যায় বলে অনুমান করেন পশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা।
করোনা মহামারির
আগে লম্বা লেজী ম্যাকাউ বানরদের চোরাচালান বড় কোনো সমস্যা ছিল না বলে জানান উইক। তিনি
বলেন, ‘লম্বা লেজী ম্যাকাউ বানরদের দাম চোরাই বাজারে ছিল একেবারেই কম। প্রতিটি
২০-৩০ ডলার। বন্যপ্রাণী বাণিজ্যের বিবেচনায় একে মোটেই উপযোগী বলা যায় না। তবে সমস্যা
হলো এখন এই দাম আগের তুলনায় ৫-১০ গুণ হয়ে গেছে।’
এদিকে ২০২২
সালে বাসস্থান সংকটের পাশাপাশি শিকার ও ফাঁদ পেতে ধরার কারণে লম্বা-লেজী বা লং-টেইলড
ম্যাকাউ বানরদের অবস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন)
বিবেচনায় সংকটাপন্ন থেকে প্রথমবারের মতো বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় উঠেছে। ওয়াইল্ডলাইফ
ফাউন্ডেশন অব থাইল্যান্ড প্রতি দুই কিংবা তিন সপ্তাহ পর পর এমন সন্দেহভাজন পাচারের
সংবাদ পাচ্ছে।
পরিবেশগত অপরাধ
বিভাগের ডেপুটি পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল এনেক নাকথর্ন জানান, পর্যটন
এলাকা, পর্যটন এলাকা নয় এমন এলাকা এবং বানরের বিচরণ আছে এমন মন্দির তাঁদের নজরদারিতে
আছে। মধ্য থাইল্যান্ডে কোভিড পরবর্তী সময় অন্তত ১০টি এ ধরনের ঘটনার কথা জেনেছেন তিনি।
পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কিছুর জায়গায় সিসিটিভি স্থাপন করা হয়েছে।
গত সপ্তাহে
উত্তর থাইল্যান্ডের নাখন সাওয়ান এলাকায় ট্রাংকুইলাইজার (চেতনানাশক) ও খাবারের টোপসহ
দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নয়টি বানরকে ধরার চেষ্টা করছিল তারা। নিশ্চিত করেন
এনেক নাকথর্ন। এগুলোর মধ্যে একটি মারা গেলেও বাকি আটটি ডিপার্টমেন্ট অব ন্যাশনাল পার্কের
তত্ত্বাবধানে আছে। পুরোপুরি সুস্থ হলে তাদের বুনো পরিবেশে ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
চোরা শিকারিরা
একবারে সাধারণত দশটির কম বানর ধরে, বলেন ডব্লিউএফএফটির প্রতিষ্ঠাতা এডউইন উইক, ‘তারপর তাদের কোনো খাঁচায় বা এমন
থলেতে রাখা হয় যেখানে অন্তত দিন দুয়েক নি: শ্বাস নিতে পারে। এর মধ্যে যতগুলো বানর ধরার
চাহিদা আছে সংগ্রহ করে ফেলতে পারে।’ সাধারণত এ ধরনের এক একটি চালানে ৫০ থেকে ১০০টি বানর সরবরাহ করা হয়।
সাধারণত ম্যাকাউ
বানরদের সীমান্ত পাড় করে পৌঁছানো হয় কম্বোডিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রে লম্বা-লেজী ম্যাকাউ
বানরদের বড় সরবরাহকারী দেশটি।
গত বছরের নভেম্বরে
কম্বোডিয়ার একজন বন্যপ্রাণী দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাসহ আট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার
করা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বন্য অবস্থা থেকে বানরগুলো ধরে
আনা, তারপর জাল আমদানি পারমিট তৈরি করা এবং সবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাগারে বিক্রি
করা। প্রাইমেট বিশেষজ্ঞ ড. লিসা জোনস-অ্যাঞ্জেল জানান, যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের অপরাধ
দমনে কঠোর অবস্থানে আছে।
এই সপ্তাহে
ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় গবেষণার কাজে ব্যবহার করা বানর সরবরাহ কর চার্লস
রিভার ল্যাবরেটরিজ জানিয়েছে, ইউএস জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট থেকে তাঁদের তলব করা হয়েছে।
কম্বোডিয়া থেকে বানরজাতীয় প্রাণী সরবরাহের বিষয়ে তদন্ত এর উদ্দেশ্য।
বন্যপ্রাণীর
অবৈধ ব্যবসার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র নতুন একটি আইন পাশ
করেছে বলে জানা গেছে বিশেষজ্ঞ ড. লিসা জোনস-অ্যাঞ্জেল সূত্রে। কোনো ওষুধ মানুষের ওপর
প্রয়োগের আগে পশুর ওপর প্রয়োগের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে বুনো
পরিবেশ থেকে ম্যাকাউ বানরদের সরিয়ে নেওয়া শুধুমাত্র নতুন মহামারির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে তা
নয়, এটি ইকোসিস্টেম ও স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যও ক্ষতিকর। ড. লিসা জোনস-অ্যাঞ্জেল বলেন,
এ বানরেরা একই সঙ্গে শিকারি, শিকার এবং বীজ ছড়ায়। মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে তারা
সাহায্য করে।
এভাবে এই প্রাণীটির
পাচারকে এক ধরনের বায়ো পাইরেসি হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
এদিকে লোয়েইয়ে
তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি মন্দিরে তিনজন লোককে অস্বাভাবিক আচরণ করতে
দেখা গেছে। ‘আমরা খবর পাই, কিছু লোক মন্দিরে রাতের বেলা এসে বানর নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা
করে।’ বলেন
প্রাচা। আলাদা-আলাদাভাবে এই লোকগুলো পাঁচটি বানরকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এদের মধ্যে
দুটি মারা যায়। ‘জেরায় এ ব্যক্তিরা জানায়, বানরগুলোকে খুব সুন্দর লেগেছিল তাঁদের, তাই
পুষতে চেয়েছিল।’ তবে এখনই গোটা বিষয়টিতে উপসংহারে পৌঁছা যাচ্ছে না বলে জানান তিনি।